কলকাতা থেকে কাছেপিঠে ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের রায়দিঘিতে স্বাগত

রায়দিঘিঃ গত কয়েক বছরে সুন্দরবন ও উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে পর্যটন শিল্প প্রসার লাভ করেছে। তবে রায়দিঘিতে পর্যটন শিল্পী কিছুটা থমকেই ছিল। এবার পর্যটক টানতে রায়দিঘি বিধানসভার একাধিক দ্রষ্টব্য স্থানগুলি নতুন সাজিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং বিধায়ক। তাঁদের উদ্যোগেই রায়দিঘির পর্যটন কেন্দ্রগুলি নতুন করে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। কলকাতা থেকে কাছেপিঠে ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের রায়দিঘিতে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। ইতিহাসিক স্থাপত্য কিংবা ধর্মীয় অনুসঙ্গ জড়িয়ে একাধিক জায়গা রয়েছে এখানে, যা ঘিরে স্থানীয় স্তরে পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

রায়দিঘি’র দিঘি
আনুমানিক দশম শতাব্দীতে চন্দ্র রাজারা বৌদ্ধ মঠের পাশে বিশাল দিঘি খনন করেছিলেন বলে কথিত আছে। পরবর্তীকালে রাজা প্রাতাপাদিত্য-এর কাকা বসন্ত রায়ের হাত ধরে সেই দিঘির সংস্কার হয়। আর সেই থেকেই দিঘির নাম হয় রায়দিঘি। স্থানীয় ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, সেই দিঘির নামেই পরবর্তী কালে গোটা এলাকারও নামকরণ হয়।

তবে পরবর্তীকালে দিঘিটি আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যায়। আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুড়াগাছা জমিদার সীতারাম রায় দিঘি সংস্কার করান। তবে অধুনা সেই দিঘির আয়তন কমেছে। সম্প্রতি রায়দিঘির বিধায়ক অলোক জলদাতা ও স্থানীয় পঞ্চায়েতের উদ্যোগে দিঘির সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় ৩০ একর এই দিঘির চারিদিকে রয়েছে সুসজ্জিত বাগান৷ পর্যটক ও ভ্রমণার্থীদের জন্য কটেজ ও ক্যাফেটেরিয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি ইচ্ছে হলে বোটিং-এরও সুযোগ থাকছে এই দিঘিতে।

জটার দেউল
রায়দিঘি থেকে মনি নদী পেরিয়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে পূর্বজটা গ্রামে রয়েছে জটার দেউল। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষকরা মনে করেন এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন রেখ দেউল। আনুমানিক নবম দশম শতকে এই দেও নির্মাণ করেন চন্দ্র বংশীয় রাজা জয়ন্ত চন্দ্র। তাঁর বৌদ্ধ ছিলেন তাই দেউলে বৌদ্ধ উপাচার হত আগে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের ফলে যেমন মূল কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে, তেমনই পাল্টেছে দেউলের সংস্কৃতিও।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফলে প্রথম দেউল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ দেউলে সংস্কার করেন লহরচন্দ্র। তিনি শৈব ছিলেন তাই দেউলে শুরু হয় শিবপুজো। পরবর্তী কালে জঙ্গল হাসিল করার সময় আনুমানিক ১৪৩০ সালে জরাজীর্ণ অবস্থায় দেউলটি আবিষ্কৃত হত। বর্তমানে দেউলটি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের আওতায় রয়েছে। তবে এই প্রাচীন দেউল দেখতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন এখানে। পাশাপাশি চারিদিকের গ্রামের নৈসর্গিক শোভা মন কাড়তে বাধ্য।

বড়াশি শিব মন্দির

রায়দিঘির আরেকটি দ্রষ্টব্য স্থান হল উম্বু লিঙ্গ শিবের মন্দির। এটি স্থানীয় মথুরাপুর-১ ব্লকের বড়াশি গ্রামে অবস্থিত। শিব ভক্তরা মনে করেন সুন্দরবনের এটি সবচেয়ে প্রাচীন শৈবতীর্থ ক্ষেত্র। কথিত আছে রাজা শশাঙ্ক নাকি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালের নিয়মে মন্দির নষ্ট হয়ে গেলে পাল ও সেন যুগে এটির সংস্কার হয়৷ তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বদনামী সম্প্রদায়ের মানুষজন এই মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। স্কন্দপুরাণ, দেবী পুরাণ, মনসামঙ্গল ও চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থের এই শৈব ভূমির কথা উল্লেখ রয়েছে। কথিত আছে একসময় নবাব আলীবর্দী খাঁ শিবের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে মন্দিরের নামে নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। সেই সঙ্গে শিবের নাম দিয়েছিলেন বুজুর্কি নাথ। ফারসি শব্দ বুজুকের অর্থ অলৌকিক। এমনকি আনুমানিক ১৫১০ সালে চৈতন্য মহাপ্রভু এই শিব মন্দিরে আসেন। পাশের নন্দর ঘাটে স্নান সেরে ছিলেন তিনি। বর্তমানে সংস্কারের পর নতুন রূপে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির। শ্রাবণ মাস ও চৈত্রমাসের ঝাপ উপলক্ষে মানুষের ঢল নামে মন্দিরে।

ছত্রভোগ ত্রিপুরা সুন্দরীর মন্দির

সুন্দরবনের ‘ত্রিপুরাসুন্দরী’ এবং ত্রিপুরার ‘ত্রিপুরেশ্বরী’র নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় আজও।মথুরাপুর-১ ব্লকের কৃষ্ণচন্দ্রপুরের ছত্রভোগ রয়েছে মা ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির। পণ্ডিতরা বলেন, ‘কুব্জিকা তন্ত্র’ অনুয়ায়ী ত্রিপুরা সুন্দরীর মন্দির ৪২টি শক্তি পীঠের একটি। এখানকার দেবীকে জ্যোতির্ময়ী রূপে বর্ননা করা হয়েছে। সে দিক থেকে বিচার করলে দেশের সতী পীঠগুলির চেয়েও অনেক প্রাচীন এই ত্রিপুরা সুন্দরীর মন্দির। ঐতিহাসিকদের মত, সুলতান হুসেন শাহ যখন মসনদে, তখন বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে ভক্তি ভাবান্দোলন। সেই সময় দক্ষিণাঞ্চল, অধুনা সুন্দরবনের অধিপতি ছিলেন রামচন্দ্র খাঁ। শাসন কাজ চালানোর পাশাপাশি ছত্রভোগের ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরে মায়ের সেবাইত হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তবে পৌরাণিক কাল থেকেই এই মন্দিরে পুজো হয়ে আসছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ ‘রাজমালা’তে উল্লেখ রয়েছে, পৌরাণিক কালে রাজা যযাতির পুত্র দ্রূহ্যু পালিয়ে এসে কপিলমুনির আশ্রমে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। তখন সুন্দরবন এলাকার নাম ছিল ত্রিবেগরাজ্য। পরবর্তী কালে তাঁরই বংশধর প্রতদ্রন কিরাত (অধুনা ত্রিপুরা রাজ্য) জয় করেন। ত্রিবেগ থেকেই কিরাত রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। তিনি প্রথম দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর পুজো শুরু করেছিলেন। পরে তাঁর বংশধররা ত্রিপুরায় চলে গেলে সেখানেও শক্তিরূপিণী মায়ের পুজো শুরু হয়। তবে ছত্রভোগের ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির অন্যতম একটি দ্রষ্টব্য স্থান।

চৈতন্য পাদপীঠ
কথিত আছে শ্রীচৈতন্য নীলাচল যাওয়ার পথে ছত্রভোগ ও বড়াশি এলাকায় বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। সেখানেই আদিগঙ্গার পাড়ে বেশ কয়েকজনকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন। সেই ওই জায়গাটি চৈতন্য পাদপীঠ নামে পরিচিত। এটি বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র। একসময় চৈতন্যদেবের প্রতিকি পায়ের ছাপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেখানে। প্রতিবছর একবার মেলাও বসে সেখানে। এটি দেখতেও ভিড় জমান দূরদূরান্তের পর্যটকরা।

এই পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে আসতে আসতে মানুষ আসতেও শুরু করেছেন। তবে সেগুলি আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রাখারও পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সঙ্গে ইকো টুরিজমেরও ভাবনা চিন্তা চলছে। এই বিষয়ে রায়দিঘির বিধায়ক ডা অলোক জলদাতা জানিয়েছেন, ‘রায়দিঘি বহু প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে৷ তার মধ্যে জটার দেউল অন্যতম। এছাড়া দিঘি সহ অন্য তীর্থক্ষেত্র রয়েছে। আমরা পর্যটকদের সামনে নতুনরূপে রায়দিঘিকে তুলে ধরছি। আমরা চাই মানুষ আসুক, রায়দিঘিকে চিনুক, এই রকম অফবিট পর্যটন কেন্দ্র সুন্দরবনে কার্যত বিরল।’

অন্যদিকে এলাকার আঞ্চলিক ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের গবেষক দেবীশঙ্কর মিদ্যা বলেন, ‘রায়দিঘিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। এখানে এসে পর্যটকরা ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলি ঘুরতে পারবেন। তবে আমার অনুরোধ একটি মিউজিয়াম গড়ে উঠুক যাতে পর্যটকরা এই এলাকার ইতিহাস ও বিভিন্ন সময়ের প্রত্নবস্তুগুলি চাক্ষুষ করতে পারে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 3 =