অশোক সেনগুপ্ত
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই স্বামী বিজ্ঞানানন্দকে একবার বলেন, ‘‘মাতৃশক্তিই হচ্ছে সমস্ত শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। এই শক্তিরই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সে এই দেশেই হোক বা অন্য দেশেই হোক।” উনিশ শতকের নবজাগরণের পথ-প্রদর্শক রাজা রামমোহন রায় থেকে সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র—অনেকেই নিজের মত করে নারীর কল্যাণে সচেষ্ট হয়েছেন। কেউ বিধবা-বিবাহের প্রচলন করে, কেউ দেবীচৌধুরানী চরিত্র মানসিক দৃঢ়তায় ও সাহসিকতায় পুরুষের তৈরি গণ্ডিকে অতিক্রম করার সাহস দেখিয়ে। এর পরেও প্রশ্ন ওঠে নারীকে আপন ভাগ্য জয় করতে কেন এত পরীক্ষা দিতে হবে? আজ আন্তর্জাতিক নারীদিবসে (international women’s day 2022) তার ওপর আলোকপাত—
‘মেয়েদের উত্তরণের লড়াইটা বেশ শক্ত’
—বীরবাহা হাঁসদা, সমাজকর্মী
ঘরে-বাইরে নানা অভিজ্ঞতায় দীর্ঘদিন অভিনয় করেছি। বাবা-মা দু’জনেই এককালের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। তাই কিছুটা বাড়তি অনুভব করার অবকাশ হয়েছে। দেখেছি মেয়েদের উত্তরণের লড়াইটা বেশ শক্ত। আগের চেয়ে মেয়েদের সুযোগ কিছু বাড়লেও রয়ে গিয়েছে সামাজিক নানা বাধা। গৃহবধূদের অনেক ক্ষেত্রে নানা কথা শুনতে হয়। অনেকে বুঝতে চাননা বধূদের ঘরের কাজ প্রায় ২৪ ঘন্টার। কে কী খাবে, কে কী পড়বে— সব কিছু পরিবারের মহিলাকে ভাবতে হচ্ছে। কখনও এর আর্থিক মূল্যায়ণ হয় না। সরকারের পক্ষে আইন করে বা পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মহিলাদের দাবিয়ে চলার মানসিকতার উর্দ্ধে উঠতে বে পুরুষদের। এর জন্য দেখেছি মেয়েদের উত্তরণের লড়াইটা বেশ শক্ত।
(মন্ত্রী, পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন অভিনেত্রী)
‘মেয়েরা তো মা দুর্গারই প্রতিরূপ, আমরা অনেক কিছু পারি’
বিদিশা বসু, উদ্যোগপতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সবলা’-তে প্রশ্ন করেছিলেন, “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা? নত করি মাথা।“ কতকাল আগেই কবিগুরু বিষয়টা নিয়ে ভেবেছিলেন। এখনও অনেকে ভাবছেন। আসলে পরিবেশের বদলের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলায়। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কেন্দ্রও রাজ্যস্তরে সরকারি নানা পরিকল্পনা থাকলেও সামগ্রিকভাবে তার সুফল মেলে যথেষ্ঠ কম শতাংশের নারীর। কারণ, প্রকল্পের প্রচারের অভাব এবং আমাদের অনেকের অজ্ঞতা।
কী করলে সামগ্রিকভাবে নারীদের ভাল হবে, সেই আলোচনায় মূলত দুটো বিষয় বলব। এক, শৈশব থেকে মেয়েদের বড় হয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার ভাবনা ঢোকাতে হবে। আমার শৈশবে বাবা মারা যান। ঠাকুর্দা আমাদের দু-বোনকে সেভাবে তৈরি করেছিলেন। দুই, মেয়েদের প্রকৃত ইচ্ছাশক্তি একটা বড় বিষয়। কলকাতার একটি নামী সিনেমা হলের মালকিন হিসাবে যখন দরকার হয়েছে হলের সমস্যা সমাধানকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। যখন মেয়ের সেরকম প্রয়োজন হয়েছে, সিঙ্গল মাদার হিসাবে তাঁর জন্য সময় দিয়েছি। লোরেটোর সিস্টার সিরিলের কাছ থেকে শিখেছি জীবনবোধ। মেয়েরা তো মা দুর্গারই প্রতিরূপ! আমরা অনেক কিছু পারি। তবে, শৈশব থেকে মেয়েদের শেখাতে হবে ক্ষমতায়নের সহজ পাঠ।
(বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালনমন্ডলীর সদস্য)
‘যেদিন নারী চাইবে এই জগৎসংসার থেকে সেদিনই পুরুষের নারীর উপর অত্যাচার বন্ধ হবে’
শ্রী ঘটক, অভিনেত্রী-সমাজকর্মী
“আমার চক্ষে পুরুষ -রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”
এ বিশ্বাস শুধু কবির নয়, এই বিশ্বাস আমারই মতো বহু সংখ্যক মান এবং হুস সম্পন্ন মানবের। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যেদিন নারী চাইবে এই জগৎসংসার থেকে সেদিনই পুরুষের নারীর উপর অত্যাচার বন্ধ হবে।
কারণ এই মানবজগৎ সৃষ্টির মূলাধারে সৃজনী প্রতিপালনে নারী। তাই প্রথম থেকেই আমাদের পুরুষ সন্তানটিকে প্রতিটি নারীকে করুণা, অবহেলা এবং সময় বিশেষে ভোগ্যবস্তু মনে না করাটা শিখাতে হবে একজন নারীকেই। তিনি হতে পারেন সম্পর্কে সেই পুরুষটির মা, দিদি, বোন বা স্ত্রী। কিন্তু আমরা অতিরিক্ত স্নেহে বা ভীত হয়ে অধিকাংশ সময় পুরুষদের অত্যাচারের নির্মম তাণ্ডব মুখ বুঝে সহ্য করি, প্রশ্রয় দি। ফলে মাতৃরূপা মৃন্ময়ীর কপালে জোটে বছরে পাঁচ দিনের অকালবোধন, আর চিন্ময়ী দেবীর কপালে জোটে নারী দিবস ….।
(চেয়ারপার্সন- ‘ত্রয়ী ফাউন্ডেশন’, ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্য)
‘নারী-পুরুষ বোধের তৃণমূল স্তরে ভিত্তি মূলত শিক্ষা’
— ভাস্বতী চট্টোপাধ্যায়, অনাবাসী, পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট
দেশের বাইরে আজ ১৮ বছর ধরে আছি। ইওরোপে থাকি। তাও যখন কর্মজীবনে সমতা রাখার কথা আসে তখনও দেখি নারীরা সব সময় সমঝোতার ওপর থাকে। এক সন্তানের মা হওয়ার সুবাদে দেখি ঘরে-বাইরে দু’দিকের ব্যস্ততা নারীদের কতটা চাপে রাখে। যদিও বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে নারীদের জন্য একটা স্বীকৃতি লক্ষ্য করা গিয়েছে।
আমার মনে হয়, নারী-পুরুষ বোধের তৃণমূল স্তরে ভিত্তি মূলত শিক্ষা, কী দেখে আমরা বড় হচ্ছি তার ওপর। বিশ্বায়ন আমাদের নারীদের পথ খুলে দিয়েছে, একঘেয়েমি থেকে বেড়িয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য তৈরির সুযোগ দিয়েছে। নারীরা নিজেদের পথ তৈরি করতে পারলে সমাজও এখনকার চেয়ে তাদের বেশি করে গ্রহণ করবে।
‘প্রতিদিনকে করে তুলতে হবে নিজের কাছে নারী দিবস’
— শ্রেয়া কর্মকার, রূপান্তরিত নারী, মডেল
আমরা ভারতবাসী, নানা মত, নানা ধর্ম, নানা ভাগাভাগির মধ্যে, নারী শক্তি শুধু খবরের পাতা আর দূর্গাপূজায়। আজ নারী দিবস নারীদের নিজেদের একটি দিন আর বাকি ৩৬৪ দিন কাদের? নারীদের জন্য আলাদা আইন, নারীদের জন্য আলাদা বাস, নারীদের জন্য আলাদা সবকিছু— এখানে করে দেওয়া হচ্ছে যে নারীরা কমজোর।
কিন্তু “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।
নারীরা মানুষ। কেন তাহলে আলাদা আইন, কেন আলাদা বাস, কেন আলাদা সিট আমরা দাঁড়িয়ে যেতে পারি। আমরা বৃদ্ধ নই! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই লোক দেখানো নাম কেনা উপহারের কোনো দরকার নেই।
নাম না করে কিছু নিজস্ব পুরুষদের, তো কিছু মহিলাদের। এই কিছু জিনিস ছেড়ে বাকি সব জিনিসই মহিলা পুরুষ সমান সমান। শ্লীলতাহানি শুধু মহিলাদেরই নয়, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদেরও হয়। সেক্ষেত্রে আইনটির সমান হওয়া দরকার।
এক হাতে তালি বাজে না। তাই আমার খাওয়া শুধু নারীদের নয় পুরুষদেরও অধিকার। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে গেলে নিজেকে মাথা উঁচু করে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে গেলে কোনও সরকার, কোনও প্রতিবেশী, কোনও স্বামী তাকে সাহায্য করবে না। নিজেকেই হতে হবে স্বাবলম্বী। একটি দিন বাদে প্রতিদিনকে করে তুলতে হবে নিজের কাছে নারী দিবস।
‘পারস্পরিক কাজের সম্মান-বোধ থাকলে প্রতিযোগীতার অসাম্য কমবে’
সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত, লেখক ও আবৃত্তিকার
নারীরা কতটা পাল্লা দিতে পারছে পুরুষের সঙ্গে । সমস্যাগুলো কী। সমাধানের পথ কী?
নারীরা কতটা পাল্লা দিতে পারছে পুরুষের সঙ্গে – এই কথাটাতেই আমার আপত্তি। এই রেষারেষি, প্রতিযোগীতার পরিবেশই ক্ষতিকারক। একটা বাড়িতে একজন করে ঘরের নানা কাজ আর আরেকজন করে বাইরে বেরিয়ে যাকে চাকরি বলা হয় সেই কাজ। দুটোই দরকার। কাজ দুটোর মধ্যে একটা ছোট বা একটা বড় এরকম নয়। মর্যাদার দিক থেকে দুটোই সমান স্তরের। এই মানসিকতাটা ভীষণ জরুরী। কোনো নারী যদি বিয়ের পর পুরনো পদবী পালটে ফেলে স্বামীর পদবী নেয় তার মানেই সেই মহিলা পুরুষের চেয়ে নিচু ক্যাটাগরির হয়ে গেল, এইধরণের বাহ্যিক তুলনার কাটা-ছেঁড়াতেই অনেক নারী বেশি মাথা ঘামায়।
পারস্পরিক কাজের সম্মান-বোধ থাকলে প্রতিযোগিতার অসাম্য কমবে এমন মনে করি। আর নারী-নির্যাতনের ধারাও কমবে। পরিবারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর সম্মানের পরিবেশে যখন ছোটরা বড় হতে পারবে তখন। লকডাউনে বাড়ি বসে থাকা পুরুষের হাতে নারী ও শিশু অত্যাচারের বাড়বাড়ন্ত এই ২০২০/২১ সালেও আমাদের শুনতে হচ্ছে এর চেয়ে দুঃখের আর কিছুই হয় না।