হাওড়া : হাওড়ার আন্দুল এলাকায় রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটলেই কানে আসে খট-খট, ঘটাং করা শব্দ। শব্দের উৎস কাঠের ও সিশার ব্লকে চলা ছাপাখানার। এই ছাপাখানাগুলোতে অতীতকাল থেকে ছেপে বেরোত ‘বাংলা নববর্ষের ক্যানলেন্ডার’। বাঙালির কাছে বাংলা নববর্ষ মানেই হালখাতা আর দোকানে-দোকানে ক্রেতাদের মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার বিলি। এইবার অবশ্য ক্যালেন্ডারের চাহিদা কম। আজ পয়লা বৈশাখ। অথচ, ক্যালেন্ডার যাঁরা বানান তাঁদের কাছে এবছর তেমন বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির বরাতই আসেনি।
হাওড়ার আন্দুল এলাকায় সত্তর বছরের পৈতৃক ব্যবসা শ্রীকুমার কুন্ডু চৌধুরীদের। তিনি নিজেও চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে ক্যালেন্ডার তৈরির কারবারে যুক্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলা হরফের চেয়ে ইংরেজি হরফের প্রচলন অনেক বেশি। বাংলা নববর্ষের আগে চাহিদা থাকলেও সারা বছর সেভাবে থাকে না। এতদিন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির বরাত দিতেন। তবে এই বছর বরাত প্রায় নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, কোভিডের জন্য এই বছরে বরাত কমলেও সামনের বছরে তা পুষিয়ে যাবে। তবে তিনি দাবি করেন, ক্যালেন্ডারের চাহিদা এক্কেবারে শেষ হবে না। কারণ, বাড়িতে বয়স্ক লোকেদের বাংলা ক্যালেন্ডার চাই-ই চাই।
আগে একান্নবর্তী পরিবার হওয়াতে লোকে তিনটে চারটে করে ক্যালেন্ডার নিয়ে যেত। এখন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ফ্ল্যাট কালচার এসেছে। দেওয়ালে পেরেক মেরে ক্যালেন্ডার ঝোলাতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছে মানুষ। তবে, বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের ঠাকুরঘরে বাংলা ক্যালেন্ডার ছাড়া চলবে না বলে দাবি তার। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিনি চোখ বুঝলে তার এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরের প্রজন্ম এই ব্যবসাতে আগ্রহী নয়। ছাপাখানার কম্পোজার অসিত দাস জানান, ছাপাখানা ব্যাবসার অবস্থা এখন খুবই খারাপ। ডিজিটাল অফসেট মেশিন বাজারে চলে আসার পরে চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকেছে। অনেক ব্যবসায়ী কোভিডের আগে প্রতিবছর ক্যালেন্ডারের অর্ডার দিত। কোভিডের পর তারাও অর্ডার দিচ্ছে না। তাই সারামাস ধরে একটানা কাজও থাকে না। ছাপাখানায় মেশিনে টাইপ কম্পোজ করেন স্বপন জানা। তিনি বলেন, আগে কাঠের, সিশার টাইপ ব্যবহৃত হতো। এখন সে সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন হাতে যে সিশার ব্লক তৈরি করা আছে তাই দিয়েই কোনরকমে কাজ চালাচ্ছেন। সেগুলো নষ্ট হয়ে গেলে কাজও বন্ধ হয়ে যাবে।
নতুন প্রজন্মের কেউ আর এই কাজে আসছে না বলে জানান তিনি। একেকটা বাংলা অক্ষর বসিয়ে ব্লক তৈরি করার ধৈর্য্য নেই এখনকার প্রজন্মের। তিনি বলেন, রাজ্যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলা ক্যালেন্ডার সহ ইংরাজি ক্যালেন্ডারের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে। ওই সংস্থাগুলির এজেন্টরা তাদের গ্রাহকদের জন্য বেশি সংখ্যায় ক্যালেন্ডারের বরাত দিত। এখন তারাও নেই, তাই সেই বরাতও নেই। তবে, একদা ইংল্যান্ডের শেফিল্ড তকমা পেয়েছিল হাওড়া। যতদিন গিয়েছে ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে একের পর এক ছোট কারখানার। এখন হাতে গোনা একটি দুটি কারখানাতে ক্যালেন্ডার ছাপার কাজ চললেও অদূর ভবিষ্যতে তাও কালের গর্ভে বিলীন হতে চলেছে, মত হাওড়ার ক্যালেন্ডার ব্যবসায়ীদের।