রাজীব মুখোপাধ্যায়, হাওড়া
অবশেষে অপেক্ষার অবসান।
শুক্রবার সকাল থেকে হুগলি নদীর নীচ দিয়ে যাত্রী নিয়ে ছুটল মেট্রো। হাওড়া ময়দান-সেক্টর ফাইভ মেট্রো রুটের উদ্বোধনের পর শুক্রবার থেকেই প্রথম যাত্রী পরিষেবা শুরু হল ওই রুটে। যাত্রীদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতোই। মেট্রোর হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত রয়েছে এই রুট। তবে এখন হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্তই পরিষেবা চালু হল। এই রুটে থাকছে চারটি স্টেশন। হাওড়া ময়দান, হাওড়া, মহাকরণ ও এসপ্ল্যানেড। এই রুটের বাকি অংশ মানে এসপ্ল্যানেড থেকে সেক্টর ফাইভ পুজোর আগে জুড়বে বলে আশা সকলের।
ব্যস্ত অফিস টাইমে প্রতি ১২ মিনিট অন্তর মেট্রো পরিষেবা চলবে। আর ব্যস্ত সময় ছাড়া চলবে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর। শুক্রবার সকাল ৭ টায় প্রথম মেট্রো ছাড়ল এসপ্ল্যানেড এবং হাওড়া ময়দান থেকে। শেষ মেট্রো ছাড়বে দু’ দিক থেকেই রাত ৯ : ৪৫ মিনিটে।
কলকাতা শহরে মেট্রো পরিষেবা চালুর ৪১ বছর পর কলকাতা মেট্রো আবারও নতুন ইতিহাস গড়লো। দেশের মধ্যে প্রথম নদীর নীচ দিয়ে মেট্রো রেল ছুটলো।
শুক্রবার সকাল থেকে বহু অফিস যাত্রী সহ উৎসুক মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
শুধুমাত্র প্রথম মেট্রোতে সওয়ার হতে হাওড়ার রামরাজাতলা থেকে এসেছেন চৈতালি মিত্র। তিনি বলেন,’ যবে থেকে টানেল খোঁড়া শুরু হয়েছিল, ভাবিনি আমার জীবদ্দশাতে নিজের চোখে দেখতে পাবো। আমাকে প্রায়ই ফুলবাগান যেতে হয়, বাসে করেই যাই। তাতে দেড় ঘন্টা সময় লেগে যায়। মেট্রো চালু হওয়াতে আমাদের মতো মানুষদের খুবই সুবিধা হল।’
হাওড়ার লিলুয়া চকপাড়ার বাসিন্দা প্রদীপ মজুমদার বলেন,’ খুবই সুবিধা হল। মায়ের পেনশনের টাকা তুলতে ধর্মতলা যেতে হতো। আধ ঘন্টা- চল্লিশ মিনিটের বেশি সময় লাগতো। এখন আধ মিনিটেই গঙ্গা পেরিয়ে যাবো।’
শুধু সাধারণ মানুষই নয় প্রথম গঙ্গার তলার মেট্রো ছড়ার অনুভূতির জন্য রাতের ডিউটি সেরে ভোর থেকে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন রেলকর্মী ভরত চন্দ্র কোলে। তিনি বলেন,’ভোর থেকে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছি। গতকাল রাতে নাইট ডিউটি ছিল, তারপরে শুধু এই অভিজ্ঞতা নেব বলেই চলে এসেছি। দেশের প্রথম এই পরিষেবা শুরু হল। কিছুদিনের মধ্যে বৌবাজার সংযোগ হয়ে গেলে আরও সুবিধা হবে।’
প্রথম সফরে মেট্রো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রতিটি যাত্রীকে গোলাপ ফুল দেওয়া হয়। যাত্রীরা প্রথম গঙ্গার তলা দিয়ে চালু হওয়া মেট্রোর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বিশেষ উৎসাহী ছিল।
প্রস্তাবিত নয়া রুট হয় সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত (১৬.৫৫ কিমি) হলেও ময়দান থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত যাত্রী পরিষেবা শুরু হয়ে গেল। এরপর বৌবাজারে কাজ সম্পুর্ন হলেই হাওড়া ময়দান থেকে সরাসরি সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত খুব দ্রুত ও সহজে পৌঁছে যাওয়া যাবে৷ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শহর হাওড়াকে মেট্রোপথে যুক্ত করলো এই করিডোর । মাটির উপর দিয়ে ৫.৭৪ কিমি এবং মাটির নীচ দিয়ে মেট্রো যাবে ১০.৮১ কিমি । মোট ১২টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। কমিউনিকেশন বেসড ট্রেন কন্ট্রোল বা (সিবিটিসি) সিগন্যালিং ব্যবস্থা থাকছে । পুরো রুটে প্রতিদিন আনুমানিক সাত লক্ষের কাছাকাছি যাত্রী যাতায়াত করবে ।
এই গোটা প্রকল্পের জন্য মোট খরচ হয়েছে ১০,৪৪২ কোটি টাকা ৷ হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত দূরত্ব ৪.৮০ কিমি । আর এসপ্ল্যানেড থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত দূরত্ব ২.৪৫ কিমি । এটি দেশের প্রথম নদীর নিচ দিয়ে চালু হওয়া মেট্রো পরিষেবা। এই অংশটিকে সাবেকুইয়াস টানেল বলা হল। এই সুড়ঙ্গ ৬৬ দিনের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। দুটি সুড়ঙ্গ বোরিং মেশিনের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে। নদীর নীচের সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য হল ৫২০ মিটার । নদীবক্ষের ১৬ মিটার নীচে অবস্থিত এই সুড়ঙ্গ । সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে দৌড়বে মেট্রো। গঙ্গার জলস্তর থেকে তলদেশের মাটি কলকাতা ও হাওড়ার পাড় প্রায় ১৩ মিটার গভীর। সেই তলদেশে থেকে আরও ১৫ মিটার গভীরে অবস্থান করছে মেট্রোর সুড়ঙ্গ দুইটি। নদীর নীচের অংশ পারাপার করতে সময় লাগবে ৪৫ সেকেন্ড । দিনের ব্যস্ততম সময়ে নদীর নীচের অংশে যাত্রী ভিড় হতে পারে আনুমানিক ৪০-৪৫ হাজার। সুড়ঙ্গের মধ্যে যে কোনো আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে যদি কোনওরকম আপদকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং যদি ট্রেন খালি করে দিতে হয়, তাহলে সুড়ঙ্গের ভেতরের ওয়াকওয়ে দিয়ে হেঁটে গিয়ে যাত্রীরা ভেন্টিলেশন সাফট দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন । আর কোনও মেট্রো স্টেশনে এই ওয়াকওয়ে নেই । এই স্টেশনের প্রত্যেক ২৪০ মিটার অন্তর একটি করে ক্রস-প্যাসেজ রয়েছে ৷ প্রয়োজনে এই ক্রস-প্যাসেজ ব্যবহার করে যাত্রীরা বেরিয়ে যেতে পারবেন । পুরো সুড়ঙ্গে এ রকম আটটি ক্রস-প্যাসেজ রয়েছে । ক্রস প্যাসেজের আরেকটি কার্যকারিতা হল যে, পাশাপাশি দুটি সুড়ঙ্গকে ক্রস প্যাসেজ যুক্ত করে । অর্থাৎ কোনও একটি সুড়ঙ্গ থেকে আর এক সুড়ঙ্গে যেতে হলে ক্রস-প্যাসেজ দিয়ে যেতে হবে ।