বন্ধের মুখে হাওড়ার অসংখ্য কারখানা, করোনা কমলেও শিল্পাঞ্চলের বিশ্বকর্মা পুজো জৌলুসহীন

হাওড়া: এক সময় হাওড়া শিল্পাঞ্চলকে বলা হত ‘শেফিল্ড অফ ইস্ট’। মূলত এখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের অসংখ্য ছোট বড় কারখানার নাম ছিল গোটা দেশজুড়ে। স্বভাবতই প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর আগে এই সব কারখানায় আয়োজন থাকত তুঙ্গে। জাঁকজমকপূর্ণভাবে হত ‘দেবশিল্পী’  বিশ্বকর্মার পুজো। বিশাল আকারের বিশ্বকর্মা মূর্তির পাশাপাশি আলোয় ঝলমল করে উঠত কারখানাগুলি। এই সময়ে কর্মীদের বোনাসও দেওয়া হত। পুজোর দিনে সারাদিন খাওয়া দাওয়া হইহুল্লোড় লেগেই থাকত শিল্পাঞ্চলে।

সেই জাঁকজমকই আজ ক্রমবিলুপ্তির পথে। বছরের পর বছর ধরে বন্ধ হয়েছে একের পর এক বড়, মাঝারি কারখানা। মুখ থুবড়ে পড়েছে হাওড়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে থাকা অনুসারী শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠা অসংখ্য ছোট কারখানা। তাই দুর্গাপুজোর বরাত ঘিরে যখন নতুন আশার আলো দেখছে কুমোরটুলি, তখন বিশ্বকর্মা পুজো ঘিরে দু-পয়সা লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না মৃৎশিল্পীরা।

গত দু’বছরের করোনা আবহ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। এবার করোনার রক্তচক্ষু না থাকলেও হাওড়ার  একাধিক ব্যবসায়ী ছোট আকারের বিশ্বকর্মার মূর্তি অর্ডার দিয়েছেন। কেউ কেউ ঘটপুজো করার ভাবনা চিন্তা রেখেছব। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মৃৎশিল্পেও।

হাওড়া শিল্পাঞ্চলে এবছর মন্দার কারণে আকারে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে বিশ্বকর্মার মূর্তি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে অর্ডারের সংখ্যা অনেকটাই কম। বিভিন্ন ছোট কারখানার মালিকেরা জানাচ্ছেন, ব্যবসার হাল তেমন ভালো নয়। তাই ঘটা করে পুজো করাও সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিমা শিল্পীদের বক্তব্য, ঠিক মতো কারখানা চলছে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিমার চাহিদা কমেছে। বেশিরভাগ জায়গায়ই কারখানা মালিকেরা ঘট পুজো করার কথা ভেবেছেন।

হাওড়ায় ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে বালি ব্রিজ, বেলিলিয়াস রোড থেকে বেলগাছিয়া জুড়ে রয়েছে ৬০-৭০ হাজার ছোট ছোট কলকারখানা। এক সময়ের ‘শেফিল্ড’ শিল্পনগরী হাওড়ার কারখানাগুলি চলত মূলত রেলের যন্ত্রাংশ, সেতু তৈরির উপকরণ, খনির যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। বছর চারেক আগেও ছবিটা অন্য রকম ছিল। ইছাপুর শিয়ালডাঙা, লিলুয়া, বেলগাছিয়া, বেলিলিয়াস রোড, কদমতলায় বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন থেকে শুরু হয়ে যেত উৎসব। কিন্তু এখন সেই ছবি পাল্টাচ্ছে।

গত চার বছরে কাজের বরাত কমেছে বলেই জানা যাচ্ছে। কম দামে এই সব যন্ত্রাংশ বহুজাতিক সংস্থাগুলি সরবরাহ করতে শুরু করায় মুখ থুবড়ে পড়েছে হাওড়ার ছোট কলকারখানা। ফলে বরাতের অভাবে একে একে প্রচুর কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারখানার ভবিষৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় অনেকে কাজ ছেড়েও দিয়েছেন। ফলে কোনও রকমে লড়াই করে টিকে থাকা কারখানাগুলিও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে আজ ধুঁকছে।

হাওড়ার এক শিল্পপতি সন্দীপ ঘোষ বলেন,  ‘সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তিগত আধুনিককরণের পথে হাঁটেনি অধিকাংশ কারখানা। যার জেরে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।’ যদিও তিনি দাবি করেন ষাটের দশকের পর থেকেই হাওড়ার শিল্প নগরীর অবক্ষয় চালু হয়। যা সত্তর দশকের পড়ে আরও গতি পেয়ে ইদানীং তলানিতে এসে ঠেকেছে। এভাবে চললে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে হাওড়া শিল্প নগরী মৃত শিল্প নগরীতে রূপান্তরিত হবে বলেই দাবি তাঁর।

পাশাপাশি হাওড়া চেম্বার অব কমার্সের আহ্বায়ক সঞ্জয় উপধ্যায়ের বক্তব্য, বর্তমানে  হাওড়ায় যে পরিমানে দক্ষ কারিগর পাওয়া যায়, তা ভারতের অন্য কোথাও আর পাওয়া যায় না।একটা সময় লাগাতার ধর্মঘট ও হরতালের জন্য ধীরে ধীরে শিল্প হাওড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বর্তমান সরকারের শিল্পনীতি ফলে পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটাই উন্নত হয়েছে। তবে শিল্পের অগ্রসরে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা নিলেও, বাস্তবে অনেকটাই খামতি থেকে যাচ্ছে।

হাওড়ার ব্যবসায়ী সুশান্ত সিংহ দাবি করেন, আগে পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। তাঁর কারখানাতেও শ্রমিকরা কাজ করতেন। এখন একাই সব কাজ করেন। এবছর ঘট পুজো করবেন কারখানাতে।

শহরের নবীন প্রতিমা শিল্পী হেমন্ত পাল বলেন, কোভিডের আগে তাঁরা প্রায় ১০০-১৫০ টি ঠাকুর বানাতেন। এখন হাতে গোনা ১০-১২ টি ঠাকুর তৈরি করছেন। কারখানা অধিকাংশ বন্ধ। বরাতও সেভাবে নেই।  ঠাকুর তৈরি করে লাভের হার তলানিতে এসে ঠেকেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 2 =