নবান্নে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পর নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলেন শ্রমিকরা। কথা ছিল, ২০ ফেব্রুয়ারি নৈহাটি শিল্পতালুকের গৌরীপুর জুটমিলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হবে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই খুলবে জুটমিল।
অপেক্ষায় ছিলেন শ্রমিকরা। কিন্তু পেরিয়ে গেল তারিখ। আশা নিয়ে থাকা মানুষগুলোর বুক থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে বন্ধ নৈহাটি শিল্পতালুকের গৌরীপুর জুটমিল। বাম আমলে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আচমকা মিলে তালা পড়ে যায়। মিল খোলার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন বিপন্ন শ্রমিকরা। শুধু তাই নয়, নির্বাচন আসলে রাজনৈতিক নেতারা শ্রমিক মহল্লায় ভোট প্রচারে এসে মিল খোলার আশ্বাস দিতেন। অভিযোগ, বাম আমলে রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন শ্যামনগরের বাসিন্দা প্রয়াত বিদুৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অথচ তিনিও মিল খোলার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেননি।
স্থানীয়দের দাবি, দেশের মধ্যে সবচেয়ে আয়তনে বড় এই গৌরীপুর জুটমিল। ইতিহাস বলছে, ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ শিল্পপতি ম্যাকলিন বেরি নৈহাটির গৌরীপুরে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের বড় জুটমিল। পাটের আঁশ থেকে এখানে সোনালী সুতো তৈরি হত। গৌরীপুর জুটমিলে তৈরি হওয়া চটের বস্তা জাহাজে চেপে পাড়ি দিত বিদেশে। এমনকি ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিকরা এই মিলে কাজে আসতেন। মিলের সাইরেনে ঘুম ভাঙতো শ্রমিক মহল্লার বাসিন্দাদের। এখন সবই অতীত। বহু বছর বন্ধ থাকায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত মিলের বাড়ি। বোলিংয়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে বড় বড় গাছ গজিয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি জুটমিল শ্রমিকদের বাসস্থান এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত। যদিও ইদানিং বন্ধ মিল খোলার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের ঘরে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের সেচ মন্ত্রী তথা নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক, আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, জুট কমিশনার তীর্থঙ্কর সেনগুপ্ত। বৈঠকে মিল খোলার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে জানিয়ে দেওয়া হয় ২০ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে মিলে রক্ষনাবেক্ষনের কাজ শুরু হবে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষনের কাজ শুরু না হওয়ায় হতাশ শ্রমিক মহল্লার মানুষজন। বন্ধ মিলের শ্রমিক বয়সের ভারে জীর্ণ স্বরাজ আনসারি জানান, মিলটি আদালতের অধীনে রয়েছে। শুনছি মিল ফের খুলবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কাউকেই মিল চত্বরে দেখা যায়নি। তাঁর দাবি, অনেক শ্রমিক অনাহারে মারা গিয়েছেন। যাঁরা জীবিত আছেন তাদের বকেয়া পাওনা গন্ডা মিটিয়ে মিল চালু হোক। মিলের হাজিরা বাবু ঠাকুর দাস পালিত বলেন, ‘মিলটা এখনও আদালতের অধীনে রয়েছে। তিনটে সিফটে পাহারাদারও নিযুক্ত আছেন। মিলের ভেতরে অবশিষ্ট বলে আর কিছুই নেই। বন্ধের পর মিলের যন্ত্রাংশ সব চুরি হয়ে গিয়েছে। মিলের বিল্ডিং ভগ্নদশায় পরিণত।’ ঠাকুরদাস বাবুর অভিযোগ, ‘পিএফ,গ্যাচুইটির টাকা কিছুই মেলেনি। ভোটের সময় রাজনৈতিক নেতারা মিল খোলার আওয়াজ তোলেন। আর ভোট মিটলে সবাই নিশ্চুপ হয়ে যান।’ গৌরীপুর জুটমিল খোলার বিষয়ে আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক পার্থ প্রতিম দাশগুপ্ত বলেন, ‘মিল চালু হতে এখনও ছয়-সাত মাস সময় লাগবে। সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক মিলটিকে খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করছি, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মিলটা চালু হবে।’ পার্থপ্রতিম বাবু এটাও জানান, মিলটা খুললে নৈহাটি-গৌরীপুর অর্থনৈতিক মানচিত্র অনেকটা পাল্টে যাবে। গৌরীপুর মজদুর বাঁচাও মঞ্চের সভাপতি সুব্রত সেনগুপ্ত বলেন, ‘বন্ধ মিলটি আদালতের অধীনে রয়েছে। তবে রাজ্য সরকার বিশেষভাবে হস্তক্ষেপ করছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তারা শ্রমিকদের বকেয়া হিসাব শ্রম দপ্তরে জমা দেবেন।’ তাঁর দাবি, শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা গন্ডা মিটিয়ে মিল খুলতে হবে।