৫ বেকার ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের চালানো স্কুলের খোঁজ রাজ্যপালের

নিজস্ব প্রতিবেদন, পূর্ব বর্ধমান: পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের চালানো বর্ধমানের জুনিয়র হাইস্কুলের বিষয়ে খোঁজখবর নিলেন রাজ্যপাল।
রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের কেউ কোনও দিন মুখ ফিরেও তাকাননি। তবুও শিক্ষকের আকালে বন্ধ হতে বসা এই রাজ্যেরই পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি জুনিয়র হাইস্কুল চালিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী এবং এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। তাঁরা কোনও বেতন বা সান্মানিকও পান না। শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা লাভের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তাঁরা বছরের পর বছর ধরে স্কুল পাঠদান করে যাচ্ছেন জেনে স্তম্ভিত বাংলার রাজ্যপাল।
শারদোৎসব কাটতে না কাটতেই ওই স্কুলটির বিষয়ে খোঁজখবর নিলেন স্বয়ং বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। আর রাজ্যপাল খোঁজখবর নেওয়ার পর থেকেই স্কুলটির হাল ফেরার ব্যাপারে আশার আলো দেখছেন স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষিকারা। পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুরের পাড়াতল ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম বসন্তপুর। একদা এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের ভরসা বলতে ছিল শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক স্কুল। আশপাশেও ছিল না কোনও জুনিয়র হাইস্কুল বা হাইস্কুল। তাই লেখাপড়া শেখার জন্য বসন্তপুর ও তার সংলগ্ন বেত্রাগড়, সজিপুর প্রভৃতি গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার দূরে জামালপুর বা সেলিমাবাদ হাইস্কুল যেতে হত। এই দূরত্ব স্কুলের বিমুখ করে তুলছিল এলাকার দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির পরিবারের ছেলে মেয়েদের। বিষয়টি নিয়ে বসন্তপুর গ্রামের অনেক মানুষজনই ভাবিত হয়ে পড়েন। সেই সময়ে গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার স্বার্থে একটি জুনিয়র হাইস্কুল গড়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নেন স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ।
এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথবাবু জানান, বসন্তপুর গ্রামে একটি জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ২০১০ সালের প্রথম থেকে লড়াই শুরু করেন। এই ব্যাপারে তিনি গ্রামের মানুষজন এবং তদানীন্তন জামালপুর ব্লকের স্কুল পরিদর্শক (এসআই) সমরেশ দাসের প্রভূত সহযোগিতা পান। ওই বছরের জুন মাসে শিক্ষা দপ্তর থেকে বসন্তপুর গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার সবুজ সংকেত মেলে। স্কুলের একটি ঘর তৈরির জন্য ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকাও অনুমোদন হয়ে যায়। কিন্তু অনুমোদনের নথিতে ত্রুটি থাকায় ‘প্রপোজাল’ ফেরৎ চলে যায়। এরপর থেকে স্কুল ঘর তৈরি নিয়ে টালবাহানা চলতেই থাকে। এমনকি স্কুলের জন্য জমি পাওয়া নিয়েও চূড়ান্ত জটিলতা তৈরি হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।
দ্বিজেনবাবু আরও জানান, শেষমেশ স্কুল তৈরির জন্য সরকারের তরফে বসন্তপুর গ্রামে দুই বিঘার মতো জমি বরাদ্দ করা হয়। তারপর পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ওই জমির তথ্য উল্লেখ করে সেখানে স্কুল তৈরির অনুমোদন দেয়। পূর্বে পাওয়া ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকায় ওই বছরেরই শেষের দিকে স্কুল ঘর তৈরির কাজ শুরু হয়। ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য চারজন ‘গেস্ট টিচারও’ মেলে। এখন স্কুলের ১৩৯ জন পড়ুয়ার মিডডে মিল রান্নার ঘর ছাড়াও টিচার্স রুম সহ পাঁচটি ঘর রয়েছে। এছাড়াও অপর একটি ঘরের নির্মাণ কাজ চলছে। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ßুñলে শিক্ষকের আকাল দেখা দিলে ßুñল চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। তাই স্বস্তিতে নেই বসন্তপুর জুনিয়র হাইßুñলের পড়ুয়ারা, অভিভাবক ও এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন। তাঁরা এখন ßুñল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন।
এমন আশঙ্কা তৈরির কারণটাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতোই। দ্বিজেন ঘোষ বলেন,‘আমাদের ßুñলের জন্য ২০১৮ সালে তিনজন স্থায়ী শিক্ষক অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এখনও পর্যন্ত ßুñলে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নেই। অতিথি শিক্ষকদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। এখন গোটা ßুñলের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন অতিথি শিক্ষক। তিনিও অসুস্থ। এই অবস্থায় শিক্ষকের আকালের কারণে ßুñল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এমন পরিস্থিতিতে ßুñলে তালা পড়া আটকাতে বেতনের প্রত্যাশা না করেই তিনি এবং আরও পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী পড়ুয়াদের পাঠদানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।’
পাশাপাশি তিনি এও জানান, ওই বেকারদের মধ্যে সুমন মাঝি ও স্বাগতা ঘোষ বাংলায় এমএ এবং শিল্পা সাহা ভূগোল ও সহেলি মণ্ডল ইতিহাসে এমএ পাশ করেছেন। আর বিশ্বজিৎ মিত্র বিএসসি পাশ। এঁদের বেশিরভাগের বিএড কোর্সও সম্পূর্ণ করা রয়েছে। দ্বিজেনবাবু জানান, নিঃস্বার্থে এই শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই এখনও ßুñলটি টিকিয়ে রাখা গিয়েছে। তবে স্থায়ী শিক্ষক ছাড়া এইভাবে আর কতদিন ßুñলটি চালানো সম্ভব হবে তা নিয়েও দ্বিজেনবাবু সংশয় প্রকাশ করেছেন। এলাকার ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষার স্বার্থে পাঁচ উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী এবং অবসরপ্রাপ্ত এক প্রবীণ শিক্ষকের এমন অবদানের কথা জেনে জেলাশাসক পূর্ণেন্দু বলেন, ‘ßুñল বাঁচাতে পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীর নিঃস্বার্থে পাঠদানের বিষয়টিকে কুর্ণিশ জানাই।’
আর লক্ষ্মীপুজো শেষে ßুñল খোলার পর দ্বিজেনবাবু বলেন, ‘আমাদের ßুñলের দুরাবস্থার বিষয়টি বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস মহাশয়ও জানতে পেরেছেন। রাজ্যপাল মহাশয়ের নির্দেশে ওনার দপ্তরের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক দিন কয়েক আগে আমায় ফোন করেন। তিনি আমার কাছে আমাদের ßুñলের বর্তমান অবস্থা, সমস্যা সহ সবিস্তার জানতে চান। এমনকি রাজ্যপাল মহাশয় যে কোনও দিন আমাদের ßুñলে আসতে পারেন।’
রাজ্যপালের দপ্তর ßুñলটির বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ায় কিছুটা হলেও আপ্লুত দ্বিজেনবাবু সহ অপর শিক্ষক-শিক্ষিকারা । দ্বিজেনবাবুর আশা, এবার হয়তো বসন্তপুর জুনিয়র হাইßুñলের সুদিন ফিরবে। জামালপুর ব্লকের ßুñল পরিদর্শক অনিন্দিতা সাহা বলেন, ‘রাজ্যপাল দপ্তর থেকে ফোন করেছিল বলে শুনেছি। ওই ßুñলের সমস্যা মেটাতে আমরাও সচেষ্ট। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো রয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 − fourteen =