হরিদ্বারের গঙ্গায় পদক বিসর্জনের পাশাপাশি আমরণ অনশনের হুমকি সাক্ষীদের

ক্রমশ জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে ভারতীয় কুস্তিগীরদের আন্দোলন। ইতিমধ্যেই দেশের সেরা খেলোয়াড়দের আটক করা হয়েছে এবং দিল্লির যন্তর-মন্তরের সামনে থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে এবার কুস্তিগীররা দাবি করেন যে তাঁরা নিজেদের যাবতীয় পদক মঙ্গলবার হরিদ্বারের গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন। আর তারপর ইন্ডিয়া গেটের সামনে বসবেন আমরণ অনশনে।
প্রসঙ্গত, ২৮ মে একদিকে সাধুসন্তদের নিয়ে রাজদণ্ড হাতে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ঠিক তেমনই অন্যদিকে রাজধানীর রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানে তোলা হতে দেখা যায় সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগটের মতো অ্যাথলিটদের। বিশ্বের দরবারে ভারতের সম্মান বাড়ানো কুস্তিগিরদের সঙ্গে অমানুষিক আচরণ করতে দেখা যায় দিল্লি অমিত শাহের পুলিশকে। প্রকৃত প্রস্তাবেই দেশের জন্য ২৮ মে ছিল ‘কালা দিবস’। সেদিনের ঘটনা নিয়ে মুখ খোলেন সাক্ষী। টুইটারে সেদিনের সমস্ত ঘটনা ব্যাখ্যা করে সামনে আনেন কিছু প্রশ্নও।
সোমবারে টুইটারে তিনি লেখেন, ‘২৮ মে যা হল তা আপনারা সবাই দেখেছেন। পুলিশ আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করেছে, কতটা বর্বরতার সঙ্গে আমাদের গ্রেপ্তার করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলাম। আন্দোলনের জায়গা তছনছ করে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হল আর পরের দিন আমাদের নামেই গুরুতর মামলায় এফআইআর করে দেওয়া হল।’ আর এই প্রসঙ্গেই সাক্ষী তাঁর টুইটে এ প্রশ্নও তোলেন, ‘মহিলা কুস্তিগিররা কি তাঁদের উপর হওয়া নির্যাতনের জন্য সুবিচার চাইতে পারবে না? পুলিশ এবং প্রশাসন আমাদের সঙ্গে অপরাধীর মতো ব্যবহার করছে, যেখানে নির্যাতনকারী বিভিন্ন সভায় আমাদের ব্যঙ্গ করছে। টিভিতে মহিলা কুস্তিগিরদের অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়া ঘটনার কথা বলে হাস্যাস্পদ করে তুলছে। এমনকী পকসো আইন পর্যন্ত বদলে ফেলার কথা বলছে। আমরা মহিলা কুস্তিগিররা ভেতরে এমন বোধ করছি যে এদেশে আমাদের জন্য আর কিছু পড়ে নেই। অলিম্পিক্স, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে পদক পাওয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে কেন জিতেছিলাম। প্রশাসন আমাদের সঙ্গে এমন জঘন্য আচরণ করবে সে জন্যই জিতেছিলাম? আমাদের টানাহেঁচড়া করল আর আমাদেরই অপরাধী বানিয়ে দিল। আমাদের বহু মহিলা কুস্তিগির খেতের মধ্যে লুকিয়ে বেড়িয়েছে। প্রশাসনের উচিত ছিল নির্যাতনকারীকে গ্রেপ্তার করা, তারা হেনস্তার শিকার হওয়া মহিলাদের তাঁদের ধরনা বন্ধ করতে, তাঁদের ভাঙতে এবং ভয় দেখানোর কাজে ব্যস্ত। এবার আমাদের মনে হচ্ছে আমাদের গলায় ঝোলানো এই পদকগুলোর কোনও অর্থই রইল না। এগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই আমাদের মৃত্যুর কথা মনে হচ্ছে, কিন্তু আত্মসম্মানের সঙ্গে সমঝোতা করে বাঁচাও তো কোনও বাঁচা নয়।’
আর সঙ্গে এ প্রশ্নও তোলেন, ‘কিন্তু প্রশ্ন হল কাকে ফেরত দেব। আমাদের রাষ্ট্রপতিকে যিনি নিজেও এক নারী। মন বলল না, কারণ তিনি আমাদের থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে বসে শুধু দেখেই গেলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে, যিনি আমাদের নিজের ঘরের মেয়ে বলতেন। মন মানল না, কারণ তিনি একবারও ঘরের মেয়েদের কথা শুনলেন না। বরং আমাদের হেনস্তাকারীকে নতুন সংসদে ডাকলেন আর সে ধপধপে সাদা পোশাক পরে ছবি তুলতে থাকল। তার সাদা পোশাক আমাদের কাঁটার মতো বিঁধছিল, যেন বলছিল আমিই প্রশাসন। এই চমকদার সিস্টেমে আমাদের জায়গা কোথায়, ভারতের মেয়েদের জায়গা কোথায়? আমরা কি শুধুই স্লোগান আর ক্ষমতায় আসার এজেন্ডা হয়ে থেকে গেলাম?’
এরই রেশ ধরে সাক্ষী এও জানান, এই পদক আমাদের চাই না, কারণ এসব পরিয়ে আমাদের মুখোশ বানিয়ে স্রেফ নিজেদের প্রচার চালায় এই সিস্টেম। তারপর আমাদের শোষণ করে। আমরা এই শোষণের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই আমাদের জেলে পোরার প্রস্তুতি নেয়। আর সেই কারণেই এই সব পদক আমরা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে চলেছি, কারণ তিনি মা গঙ্গা। যতটা পবিত্র আমরা গঙ্গাকে মনে করি ততটা পবিত্রতার সঙ্গেই পরিশ্রম করে এই পদক পেয়েছিলাম। এই পদক সাড়া দেশের কাছেই পবিত্র এবং পবিত্র পদককে রাখার সঠিক জায়গা পবিত্র মা গঙ্গাই হতে পারে। আমাদের মুখোশ বানিয়ে ফায়দা তোলার পর আমাদের নির্যাতনকারীর পাশে দাঁড়িয়ে পড়া সিস্টেম পদক রাখার জায়গা হতে পারে না। পদক আমাদের প্রাণ, আমাদের আত্মা। এদের গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার পর আমাদের বেঁচে থাকার কোনও অর্থই থাকবে না। এজন্য আমরা ইন্ডিয়া গেটে আমরণ অনশনে বসব। ইন্ডিয়া গেট সেই শহীদদের জায়গা যাঁরা দেশের জন্য প্রাণত্যাগ করেছিলেন। আমরা তাঁদের মতো পবিত্র নই, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার সময় আমাদের ভাবনাও তাঁদের মতোই ছিল। অপবিত্র সিস্টেম নিজেদের কাজ করছে এবং আমরা আমাদের কাজ করছি। এবার মানুষকে ভাবতে হবে তাঁরা এই মেয়েদের পাশে দাঁড়াবেন নাকি মেয়েদের নির্যাতন করা ওই ধপধপে সাদা সিস্টেমের পাশে।‘ এরই রেশ ধরে সাক্ষী এও জানান, ‘মঙ্গলবার সন্ধে ৬টায় আমরা হরিদ্বারে পদক গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব। এই মহান দেশের প্রতি আমরা সদা কৃতজ্ঞ থাকব।‘
অন্যদিকে দেশের অপর কুস্তিগীর বজরং পুনিয়া বললেন, ‘গত ২৮ মে কী হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। পুলিশ আমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছে, সেটাও এখন আর কারো কাছে অজানা নয়। আমাদের অত্যন্ত বর্বরতার সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ এবং প্রশাসন আমাদের সঙ্গে অপরাধীদের মতো ব্যবহার করেছে। এই পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আমাদের গলায় এই পদকগুলোর আর কোনও অর্থই নেই। এটা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা মনে করাটাই আমাদের কাছে মৃত্যুর সামিল। কিন্তু, আমরা আত্মসম্মানের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করতে পারব না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − two =