এগরার বিস্ফোরণ কেড়ে নিল খাদিকুলের ৮টি প্রাণ মা-বাবা হারা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত পরিবার

মদন মাইতি, এগরা: এগরার ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেড়ে নিল ছোট্ট শিশুদের মা ও বাবাকে। ৬ বছরের অনিতার বোঝারও ক্ষমতা নেই ঠিক কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে তাঁর জীবনে। সে জানেই না মৃত্যু কি! সঙ্গীদের সঙ্গে খেলার মাঝে মধ্যেই মা কে জিজ্ঞেস করছে ‘বাবা কখন আসবে?’ বাবা জয়ন্ত জানা যে আর কোনও দিনই ফিরবেন না সেটুকু বোঝার বয়স হয়নি তাঁর। মা সুমা দেবী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে কোনও রকমে আশ্বাস জোগচ্ছেন ছোট্ট মেয়েটিকে ‘আসবে আসবে।‘

১৬ মে মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা ১০, প্রচুর গাছপালা এবং পশু পাখির সাথে কেঁপে ওঠে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার মনোরম খাদিকুল গ্রাম। গ্রামবাসী ছুটে এসে দেখেন ভানু বাগের বাজি কারাখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই ভানু বাগ খাদিকুলে অবৈধ ভাবে বাজি তৈরির কারবার চালাচ্ছিল। অবৈধ বাজির আড়ালে যে বোমা তৈরি করা হচ্ছিল তা খাদিকুলের গ্রামবাসীরা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।

‘বাজিগর’ ভানুর কারখানার এই বিস্ফোরণ কেড়ে নিয়েছে তরতাজা ৮ টি প্রান। প্রান হারিয়েছেন মাধবী বাগ, শ্যামাশ্রী মাইতি, শক্তিপদ বাগ , জয়ন্ত জানা, কবিতা বাগ, মিনতি মাইতি, অলোক মাইতি ও অম্বিকা মাইতি। এরা প্রত্যেকেই নিজের ছেলে মেয়েকে রেখে গেছেন। স্বল্প দৈনিক মজুরিতে ভানুর অবৈধ বাজি কারখানার কাজ করতেন এঁরা।

এদিকে মাধবী বাগের দুটি ছেলে‌। আকাশ বাগ (১৩) ও অংশু বাগ (৮)। অংশুর হাতে তখনও মোবাইলে মায়ের ছবি। ১৩ বছর বয়সী আকাশ জানায়, ‘বিস্ফোরণের ঠিক আগেই আমি মাকে ডাকতে যাই। বাড়ি ফিরে একটা বিকট শব্দ শুনতে পাই । তখন ভেবেছিলাম যে তারা বোমা পরীক্ষা করছে। কিন্তু যখন বাইরে আসি দেখি সর্বত্র আগুন।‘

অংশু এবং আকাশ একমাত্র সন্তান নয় যারা তাঁদের মাকে হারিয়েছে।

তবে ভানু বাগের ব্যাপারে মোটেই ভাল কিছু বলতে শোনা গেল না এলাকার মানুষজনকে। বিশেষত যাঁরা বিস্ফোরণে হারিয়েছেন তাঁদের নিকট আত্মীয়দের। জয়ন্ত জানার স্ত্রী সুমা জানা জানান, ‘ভানু তার স্বামীকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে মদ খাইয়ে তার অবৈধ কারখানায় কাজ করার জন্য নিয়ে যেত।‘ প্রায় একই সুর এই বিস্ফোরণে মৃত কবিতা বাগের এক আত্মীয়র গলাতেও। তিনি জানান, ‘ভানু বাগ প্রভাব খাটিয়ে লোকজনকে তার অবৈধ বাজি কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করেছিল।‘

এর মধ্য়ে ২৬ বছর বয়সী পিঙ্কি মাইতি বাজি কারখানার কাজ করা মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী‌। বিস্ফোরণের ঝলসে যাওয়া দেহ নিয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন তিনি। তার ৮ বছরের ছেলে শুভরঞ্জন গ্রামের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে থাকে। সাংবাদিকরা বাড়ির সামনে যেতেই তাঁ আকুল প্রশ্ন, ‘আপনারা কি জানেন আমার মা কবে আসবে।’

এদিকে মা-বাবাকে হারিয়ে বড়দের পাশাপাশি ছোট্ট শিশুরাও সাদা ধুতি পরে আছে। কখনো খাওয়া হচ্ছে তো কখনও তাও না। গ্রামের অনেকের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে না। প্রশ্ন একটাই মা ‘বাবা হারানো ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কি হবে। কে তাদের দায়িত্ব নেবে।’

এসবের মধ্যেই, ওড়িশার একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় এগরা বিস্ফোরণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ভানু বাগের। সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবাররাত ২টো ৪০ নাগাদ মৃত্যু হয় তার। এগরা বিস্ফোরণের পর পলাতক ছিল ভানু। এরপর তল্লাশি চালিয়ে ওড়িশা থেকে সিআইডি গ্রেপ্তার করে তাকে। ভানুর সঙ্গেই গ্রেপ্তার করা হয় তার ছেলে এবং ভাইপোকেও।

এদিকে সূত্রে খবর, মঙ্গলবার বিস্ফোরণের পর ভানু ওড়িশা অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পালিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও শেষরক্ষা হয়নি। কারণ, অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল দেহের ৮০ শতাংশ। অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় তার জবানবন্দি নেওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নিদগ্ধ অবস্থাতেই মৃত্যু হয় তার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 2 =