বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ! মায়ানগরীতে স্বপ্ন বাস্তব হরমনদের

২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের দুঃখ, ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের কাছে ফাইনালে পরাজয়ের বেদনা—এই সব ব্যর্থতা যেন নতুন করে প্রেরণা হয়ে ফিরে এসেছিল হরমনপ্রীত কৌরদের মধ্যে। অবশেষে সেই সমস্ত ‘হয়নি’র গল্পের সমাপ্তি ঘটল ২০২৫ সালের ২ নভেম্বর, নবি মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো মহিলা ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতল ভারত। ভারতীয় ক্রিকেটে যুক্ত হল এক নতুন ইতিহাস—‘উইমেন ইন ব্লু’র বিশ্বজয়ের অধ্যায়।

মুম্বই, যাকে বলা হয় মায়ানগরী—যেখানে স্বপ্ন বাস্তব হয়। ২০১১ সালে এই শহরেই পুরুষ দলের হাতে উঠেছিল বিশ্বকাপ। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে পুরুষ দলের বিশ্বকাপ ফাইনালের ব্যর্থতা দেশবাসীকে কাঁটার মতো বিঁধেছিল। সেই আঘাতের বদলা যেন এদিন নিলেন ভারতীয় মেয়েরা। প্রতিটি ব্যর্থতার মতোই এই জয়ও প্রমাণ করল—হার মানা মানসিকতা নয়, জেদই সাফল্যের চাবিকাঠি।

দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক লরা উলফার্ট টসে জিতে ভারতকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠান। বৃষ্টিভেজা মুম্বইয়ের আর্দ্র আবহাওয়ায় ইনিংস শুরু করেন স্মৃতি মন্ধানা ও শেফালি বর্মা। শুরুটা ধীর হলেও, ধীরে ধীরে রানের গতি বাড়িয়ে ১৮ ওভারের মধ্যেই গড়ে তোলেন শতরানের পার্টনারশিপ। কিন্তু সেই ছন্দেই আসে ধাক্কা—৪৫ রানে ক্লোয়ি ট্রায়নের বলে উইকেট হারান স্মৃতি। এরপরও শেফালি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট চালিয়ে যান। মাঝপথে একবার জীবনদান পেলেও তাঁর ৭৮ বলে ৮৭ রানের ইনিংস ভারতকে দৃঢ় ভিত্তি দেয়। চোট নিয়েও এমন ইনিংস রীতিমতো অনন্য। যদিও সেঞ্চুরির সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় খানিক আফসোস রয়ে যায়।

ভারতের ইনিংস শেষ হওয়ার পর শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার জবাবি লড়াই। ওপেনার তাজমিন ব্রিটস রানআউট হয়ে ফেরেন মাত্র ২৩ রানে, আনেকে বশ শূন্য হাতে ফেরেন শ্রী চরণীর বলে। তবুও লরা উলফার্টের ব্যাট ছিল অটল। একদিকে তিনি সুনে লুসকে সঙ্গে নিয়ে ইনিংস এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হরমনপ্রীত তখন বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে বোলিংয়ে আনেন শেফালিকে। ব্যাট হাতে নায়কোচিত ইনিংস খেলা শেফালি বল হাতে পরপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে ম্যাচে ফেরান ভারতকে।

তবুও বিপদ পুরো কাটেনি। রাধা যাদবের এক ওভারে ওঠে ১৭ রান। ডের্কসেন ঝড় তুলে দেয় ম্যাচের গতি পাল্টে দেওয়ার ইঙ্গিত। অন্যদিকে লরা উলফার্ট তুলে নেন তাঁর সেঞ্চুরি। তখনই যেন মনে হচ্ছিল, ম্যাচ হাতছাড়া হতে পারে। কিন্তু ভাগ্য তখন ভারতের পক্ষে। দীপ্তি শর্মা এক দারুণ স্পেলে ফিরিয়ে দেন ডের্কসেনকে। আর লরার আকাশে তোলা শটে অমনজ্যোত এক হাতে ধরলেন বল—তৃতীয় প্রচেষ্টায়। যেন গোটা ভারতবর্ষের স্বপ্ন মুঠোয় বন্দি হল তাঁর হাতে।

শেষ পর্যন্ত দীপ্তির ৫ উইকেট, শেফালির ঝলমলে ইনিংস ও হরমনপ্রীতের নেতৃত্বে ভারত ৫২ রানে জিতে নেয় বিশ্বকাপ। এই জয় শুধু ট্রফি জয়ের নয়—এটি এক প্রতিজ্ঞার পরিণতি, এক অসম্পূর্ণ গল্পের পূর্ণতা। ২০০৫ বা ২০১৭-র ব্যর্থতা আজ ইতিহাস। ২০২৫ সালের নভেম্বরের এই রাতটা ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে—যেদিন হরমনপ্রীতদের নেতৃত্বে ‘উইমেন ইন ব্লু’ সত্যিই হয়ে উঠল বিশ্বজয়ী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 + 4 =