গলা এফোঁড়-ওফোঁড় ত্রিশূলে, রোগীকে নতুন জীবন দিল এনআরএস

কলকাতা: একঝলক দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে।ত্রিশূল গলার একপাশ দিয়ে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বেরিয়েছে। এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত।

ত্রিশূল বেঁধা অবস্থায় ঘাড় শক্ত করে ডাক্তারবাবুদের অপেক্ষা করছেন যুবক। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের  জরুরি বিভাগে এমনই এক যুবককে দেখে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল ডাক্তারদের। এমন সাঙ্ঘাতিক ঘটনা দেখে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল জরুরি বিভাগে আসা রোগী ও তাঁদের পরিজনদেরও। কিন্তু যুবক নির্লিপ্ত। যন্ত্রণা চেপে নির্বিকার ঘোরাঘুরি করছিলেন, কথাও বলছিলেন।
যুবকের গলা থেকে ত্রিশূল বের করে আনা সহজ কাজ ছিল না। সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করল এনআরএস হাসপাতাল। দেড় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের পরে নিপুণ দক্ষতায় সেই ত্রিশূল বের করে এনেছেন এনআরএসের ইএনটি বিভাগের অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা। গলার ক্ষত সারানো গেছে অনেকটাই। যুবকের অবস্থা এখন স্থিতিশীল। তাঁকে জেনারেল ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছে।

কীভাবে এই জটিল অস্ত্রোপচার হল?

ইএনটি বিভাগের অধ্যাপক ডা. প্রণবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, রাত তখন ৩টে। সেই ভোররাতে এনআরএসের জরুরি বিভাগে গলায় ত্রিশূল বেঁধা অবস্থায় একজন রোগী আসেন। ত্রিশূলটা পুরোপুরি গেঁথে গিয়েছিল গলায়। সেই অবস্থায় যুবক কথাও বলছিলেন। তখন গলা থেকে তাঁর রক্ত ঝরছে। সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তাররা। তৈরি হয় মেডিক্যাল টিম। এনআরএসের ইএনটি বিভাগের অধ্যাপক ও সার্জন ডা. প্রণবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ডা. সুতীর্থ সাহা, ডা. অর্পিতা ও অ্যানেসথেসিস্ট ডা. মধুরিমা ছিলেন সেই টিমে।
ডা. প্রণবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, এই ধরনের অস্ত্রোপচারে ঝুঁকি অনেক বেশি। বিশেষ করে যেখানে ধারালো ত্রিশূল গলা ফুঁড়ে ঢুকে গেছে। গলার ভেতরের কতটা ক্ষতি হয়েছে, শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, ভোকাল কর্ডের কী অবস্থা, সেটা আগে থেকে বোঝা যায় না। তাই অস্ত্রোপচারেও কতটা সময় লাগবে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের সময়ে ট্রাকিওস্টমি করা হয়। গলার একটু নিচের দিকে ফুটো করে ৮ মিলিমিটার ব্যাসের ‘ট্র্যাকিওস্টমি টিউব’ ঢোকানো হয় রোগীর কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর জন্য। অস্ত্রোপচার চলার সময়েও রোগী যাতে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়। শ্বাসনালিতে উইন্ডপাইপ  ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই উইন্ডপাইপের কাজ হল শ্বাসপ্রশ্বাসকে স্বাভাবিক রাখা। ফুসফুসে যাতে বায়ু চলাচল করতে পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়।

গলা ফুঁড়ে ত্রিশূল ঢুকে গিয়েছিল অথচ যুবকের শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, ভোকাল কর্ডের কোনও ক্ষতি হয়নি। মুখের বাইরে রক্ত লেগে থাকলেও, মুখের ভেতরে রক্ত বের হয়নি। ওই অবস্থাতেও তাই যুবক কথা বলতে পারছিলেন। তবে ক্ষত কতটা গভীরে গিয়েছিল সেটা জানা দরকার ছিল আগে। সে জন্য ট্রাকিওস্টমি করে শ্বাসের গতি স্বাভাবিক রেখে অ্যানাস্থেসিয়া করা হয় যুবকের। তারপর ধীরে ধীরে ত্রিশূল বের করে আনা হয় গলা থেকে। দেড় ঘণ্টার অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা।

জানা গিয়েছে, যুবকের নাম ভাস্কর রাম। কল্যাণীর গয়েশপুর পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আনন্দপল্লির বাসিন্দা। তিন বন্ধুর মধ্যে ঝামেলার জেরেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। গলায় ত্রিশূল ঢুকিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ত্রিশূলবিদ্ধ অবস্থায় ভাস্করকে কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু জেএনএম হাসপাতালে ত্রিশূল বের করতে না পারায় রাতে ওই অবস্থাতেই কলকাতায় নিয়ে আসা হয় তাঁকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 2 =