এবার পুজোয় চারটি বালুচরীতে চমক বিষ্ণুপুরের অমিতাভর

নিজস্ব প্রতিবেদন, বিষ্ণুপুর: মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুরের নাম এখন বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেয়েছে। টেরাকোটা মন্দিরের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরের খ্যাতি ছড়িয়েছে এখানের নিজস্ব ঘরানায় তৈরি করা বালুচরী শাড়ির। বিষ্ণুপুরের বালুচরী শিল্পী অমিতাভ পাল এবার পুজোর চমক দিতে নতুন আঙ্গিকে হাজির করলেন ৪টি শাড়ি। তার মধ্যে ১টি শাড়ির দাম রাখা হয়েছে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। যা বিষ্ণুপুরকে নতুন করে পরিচয় করাবে।
মল্লরাজাদের তৈরি টেরাকোটা মন্দিরশ্রেণি দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা বারবার ছুটে আসেন বিষ্ণুপুরে। সেই মল্লিভূমের মুকুটে আরও একটি পালক জুড়েছে বিষ্ণুপুরে তৈরি ‘বালুচরী’ এবং ‘স্বর্ণচরী’ শাড়ি। যে শাড়ির কদর এখন রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সাবেক কাল থেকে বালুচরী শাড়িতে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের নানান উপাখ্যান উঠে এসেছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে শাড়িতে বোনা সাবেকি সেই প্রথাকে নিজের ভাবনার জালে জড়িয়ে ভেঙেছেন শহরের কৃষ্ণগঞ্জের বাসিন্দা বালুচরী শিল্পী অমিতাভ পাল। তাঁর ভাবনায় প্রথাগত বুনুন থেকে বেরিয়ে এসে ইতিমধ্যেই তিনি তৈরি করেছেন এরি, মুগা, কটকি সহ কাব্য কাহিনির চরিত্র নিয়ে ‘রূপশালি বালুচরী’ ‘তিনকন্যা বালুচরী’ সহ আরও বিভিন্ন ডিজাইনের বালুচরী শাড়ি।
সম্প্রতি বালুচরীর বুনুনে তিনি অসমের ‘মেখলা’ বুনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বস্ত্র বিভাগ থেকে রাজ্য সম্মান পেয়েছেন। আগের শাড়িগুলিও তাঁকে রাজ্য সম্মান এনে দিয়েছে। এরপর তাঁর হাত ধরে এসেছে বহু মূল্যের ‘দেড়লাখি বালুচরী’। বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজে অ্যাকাউনটেন্সি নিয়ে পড়ার সময়ই বাবাকে হারানো অমিতাভ মামা শ্যামসুন্দর লক্ষণের কাছে তাঁতে মাকু টানা শিখে নেন। পরে সাহস করে একদিন বসে যান মামার তাঁতশালে। বালুচরীর গ্রাফ দেখে দেখে শুরু হয় তাঁতে রেশম সুতো বসিয়ে মাকু টানা।
মামা মারা যাওয়ার পর মামাবাড়িতে বড় হয়ে ওঠা অমিতাভর কাঁধে পড়ে সংসারের ভার। তখন দিনরাত এক করে শাড়ি বুনতেই থাকেন। একসময় তাঁত বোনায় অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন অমিতাভ পাল। তবে ফুল, লতাপাতা বা রামায়ণ, মহাভারতের উপাখ্যান বুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন শিল্পী। তাই দিন যেতে সেই একঘেয়েমি ডিজাইন অমিতাভবাবুর শিল্পী মনের খিদে বাড়িয়েই চলেছিল। তাই ভাবলেন, কেমন হয় বালুচরীর গ্রাফের ডিজাইনগুলি একটু অদলবদল করে দিলে? তাঁর ভাবনার বীজে সোনার ফসল ধরল। অমিতাভর ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিটি শাড়ি বিপুল চাহিদা পায়।
২০০৫-২০২১ সাল পর্যন্ত তাঁর তৈরি প্রতিটি শাড়ি রাজ্য সম্মান পেয়েছে। ওই শাড়িগুলোর জন্য অমিতাভবাবু পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ওড়িশা, অসম, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ সরকারের কাছ থেকে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছেন। রাজ্য সরকারের বস্ত্র বিপণন বিভাগের ‘তন্তুজ’ ও ‘মঞ্জুষা’ তাঁদের সমস্ত শো-রুমের জন্য ওইসব শাড়ির বরাত পাঠাতে থাকে। এবার পুজোয় অমিতাভ পালের ভাবনায় নতুন আঙ্গিকে রূপ পেয়েছে একসঙ্গে ৪টি শাড়ি। শাড়িগুলোর বিশেষত্ব অনুযায়ী নামকরণ করা হয়েছে। যেমন দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক ‘অষ্টমী বালুচরী’, জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্ত জেলার ৩ শিল্প টেরাকোটা, ডোকড়া ও বালুচরী নিয়ে ‘ত্রিকূট’, অবাঙালিদের পছন্দের ডিজাইনে বোনা ‘সবরমতী’ এবং ৮টি পাড়যুক্ত বাদশাহী ডিজাইনের ‘তিন লাখি’ শাড়ি।
এই শাড়ির বিষয়ে অমিতাভ পাল বলেন ‘আমার ভাবনার স্বীকৃতি আমি অনেক আগেই পেয়েছি। এবার ৪টি নতুন ধরনের এমন শাড়ি তৈরি করেছি, যা আগে কখনও কেউ ভাবতে পারেনি। তিন লাখ টাকা দামের শাড়ির কথাও কেউ কল্পনায় আনতে পারেনি। কিন্তু এবারের সব শাড়িই রাজ্য সরকারের বস্ত্র বিভাগ পছন্দ করেছে। ইতিমধ্যে শাড়ির বরাতও দিয়েছে। এবার পুজোয় এই শাড়িগুলি বাজার মাতাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten + 6 =