দুর্ভিক্ষ থেকে প্রজাদের বাঁচাতে মাধবপুরের রায় জমিদার পরিবারে শুরু দুর্গার আরাধনা

মহেশ্বর চক্রবর্তী

হুগলি: ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে যখন গ্রামকে কে গ্রাম মানুষ উজাড় হয়ে যাচ্ছে, খাবারের জন্য চলছে হাহাকার তখন আর চুপ থাকতে পারেননি জমিদার শান্তিরাম রায়। জমিদার বাড়ির শস্য ভাণ্ডার সকলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রজা কল্যাণে মা দুর্গার আরাধনায় তিনি ব্রতী হয়েছিলেন। মন্বন্তরের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
সেই শুরু। পুজোর দিনক্ষণ, সাল এখন আর কেউ সঠিক বলতে পারেন না। জমিদারিও নেই। তবে আজও পরম ভক্তিতে পুজো হয়ে আসছে আরমবাগের মাধবপুরের রায় জমিদার বাড়ির।

মাধবপুর এলাকায় আজও লোকশ্রুতি ছড়িয়ে আছে। জনহিতের কল্যাণে দেবী দুর্গার আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন শান্তিরাম রায়। প্রজাহিতৈষী এই জমিদারকে বর্ধমানের রাজা মহাত্রাণ উপাধি দিয়েছিলেন। শতাধী প্রাচীন এই পুজোতে আজও দেবী দুর্গার কাছে অশুভ শক্তির বিনাশের প্রার্থনা করা হয়।
গড়বাড়ির রাজা রণজিৎ রায়ের বংশধর মাধবপুরের জমিদার পরিবার। মোগল ও আফগান লড়াইয়ের সময়কালে গড় মান্দারণের সঙ্গে গড়বাড়ি দুর্গ ধ্বংস হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা হুগলি জেলার হামীরবাটি , শ্যামবাটি, মাধবপুর, গোপীনাথপুর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। রণজিৎ রায়ের বংশধরদের একটি শাখা আরামবাগের মাধবপুর এলাকায় ভদ্রাসন গড়ে তোলেন। এই বংশের শান্তিরাম রায় বর্ধমান রাজ কর্তৃক ১৭৭০ খ্রিস্টাধে বায়রা পরগনা, বদনগঞ্জ, উচালন ও পহলানপুরের জমিদারি পান। সেই সময়কালে ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। সন্তানসম প্রজাদের রক্ষায় শান্তিরাম ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রজা কল্যাণে মা দুর্গার আরাধনায় তিনি ব্রতী হয়েছিলেন। মন্বন্তরের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
১৭৯২ সালে জমিদার বাড়িতে দেবী দুর্গার ঠাকুর দালান নির্মিত হয়। দুই শতাধী ধরে সেই ঠাকুর দালানে আজও পুজো হয়ে আসছে। শান্তিরামের অস্টম উত্তরপুরুষ শুভদীপ রায় বলেন, আমার পূর্বপুরুষরা রাজপুত গোষ্ঠীর চান্দেলা প্রতিহার বংশের ছিলেন। এই বংশের একটা শাখা বর্তমান বিহারের মুঙ্গের জেলার গিধাউরি এলাকার শাসক ছিল। সেই বংশের সংগ্রাম সিং গৌরঅধিপতির কাছে ‘রায়’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর ছেলে রঞ্জিত রায় সম্ভবত গড় মান্দারণের সমরশাসকের বা অন্য কোনও উচ্চপদের দায়িত্বে ছিলেন। মোগল আফগান যুদ্ধে এই বংশের সদস্য হরিশ্চন্দ্র রায় যুদ্ধে মারা যান। পারিবারিক নথিপথে প্রাচীন এই ইতিহাস কিছু রয়ে গিয়েছে। যদিও মূল স্রোতের ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে সেইসব স্থান পায়নি।
পরিবারের ঐতিহ্য ও রীতি মেনেই আমাদের এই পুজো এখনও হয়। বাড়ির অপর সদস্য অমলেন্দু রায় বলেন, আমাদের পুজো শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী কল্পারম্ভ দিয়ে। নবমী থেকে নবমী বিশেষ অনুষ্ঠান ও পূজা হয়। এই পুজোর বিশেষত্ব হলো দশভূজা মূর্তিতে কুলোদেবী বিশালক্ষীকে আরাধনা করা। রাজা রণজিৎ এর ব্যবহৃত তরবারি ক্ষত্রিয় বংশ ও ক্ষাত্র তেজের প্রতীক হিসাবে পুজো করা হয়। পূজাতে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত বিশেষ মহাদুর্গা হোম হয় ১০০৮ আহুতি সহ। এই হমগ্নি তিন দিন জ্বলতে থাকে। দশমীতে বিশেষ রীতি অনুযায়ী মহামন্ত্র পাঠ করা হয়। দশমীতে ঘট নিরঞ্জনের আগে এক বিশেষ প্রথা অনুসারে আজও খাজনা নেওয়া হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =