প্রযুক্তির যুগে মানুষের যে চিন্তাভাবনা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে তা আরো একবার প্রমাণ হল চাঁচল রাজবাড়ির দেবী দুর্গা বিসর্জনের সময়। যদিও প্রাচীন প্রথা মেনে দশমীর সন্ধ্যায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা লন্ঠনের আলো দেখিয়ে থাকেন নদী পাড়ে। আর সেখানেই দেবী মাতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তো উপস্থিত হয়েছিলেন নদী পাড়ে, কিন্তু লন্ঠনের বদলে বেশিরভাগ মানুষের হাতেই ছিল টর্চ এবং মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট।
বুধবার দশমীর গোধূলি লগ্নে দেবীকে বিদায় জানাতে নদী পারে হাজির হন কৌরব, রহিম ও সাইফুলদের মতো অনেকেই। তবে খালি হাতে নয় , হাতে ছিল টর্চ, মোমবাতি ও মোবাইলের ফ্লাশ লাইট। সেই দিয়েই দেবী চণ্ডীকে বিদায় জানালেন তারা। দেবী দুর্গা চাঁচল রাজবাড়ির পুজোয় চণ্ডী রূপে বিরাজমান। তবে এই প্রথা আজকের নয় প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। প্রতি বছর দশমীর দিন গোধূলি লগ্নে চাঁচলের পাহাড় পুরের চণ্ডী মাতার বির্সজন পর্বে দেখা মেলে এক সম্প্রীতির ছবি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নবমীর রাতে ওই গ্রামের কোনো এক মুসলিম ব্যক্তি মা চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পান। দেবী স্বপ্নে তাঁকে নির্দেশ দেন, দশমী তিথির গোধূলিলগ্নে ওই গ্রামের মানুষজন যেন তাঁকে লণ্ঠনের আলো দেখায়। সেই স্বপ্নাদেশ মেনে সাউড়গাছি গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা দশমীর দিন মায়ের বিদায়বেলায় লণ্ঠন জ্বালিয়ে তাঁকে আলো দেখান। এরপরেই ওই গ্রাম থেকে মহামারি দূর হয়ে যায়। সেই থেকে আজও সংশ্লিষ্ট এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা দেবীর বিসর্জনের সময় মরা মহানন্দা নদীর অপর প্রান্তে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা জড়ো হয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে আলো দেখান।
প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো রীতি মেনে দেবীদুর্গার বিদায়বেলায় লণ্ঠনের আলো দেখিয়ে তাঁকে বিদায় জানান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন। সম্প্রীতির এই দুর্লভ ছবির দেখাও পাওয়া যায় চাঁচলের মরা মহানন্দা নদীর তীরে। চাঁচল পাহাড়পুরের চণ্ডীপুজো এখন চাঁচলবাসীর কাছে রাজবাড়ির পুজো হিসাবে পরিচিত। দেবীর এখানে চার হাত। রাজবাড়ির এই দেবীদুর্গা চণ্ডীরূপে পূজিত হন। যদিও বর্তমানে রাজা আর নেই রাজপরিবারও নেই। কিন্তু রয়ে গেছে রাজ আমলে প্রবর্তিত রীতি। আর সেই রীতি মেনেই দশমী তিথির গোধূলিবেলায় মন্দিরের সামনে ২০০ মিটার দূরে মরা মহানন্দায় বিসর্জন দেওয়া হয় দেবী প্রতিমাকে। আর নদীর ওপারে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন লণ্ঠনের আলো জ্বালিয়ে মাকে এবছরের মতো বিদায় জানান। কিন্তু কয়েকশো বছরের এই প্রবর্তিত রীতিতে ঘটল আমূল পরিবর্তন। বিজ্ঞানের যুগে আর হারিকেন জ্বেলে নয় টর্চ ও মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেবীকে বিদায় জানালেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন। ওই গ্রামের কৌরাব আলি, শেখ সাহিফুল ও রহিম আলিরা টর্চ ও মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে দেবী চণ্ডী মাতাকে বিসর্জন দিলেন। তাদের বক্তব্য, লণ্ঠন এখন খুবই দুর্লভ। তার ওপর কেরোসিনের দাম বেড়েছে। তাই অনেকেই এখন মোবাইল ও টর্চ লাইটের আলোতেই মাকে বিদায় জানিয়েছেন।