সরকারের কাছে লুপ্তপ্রায় শিল্পকে বাঁচানোর আর্জি পটুয়াদের
নিজস্ব প্রতিবেদন, বালুরঘাট– বাজার মন্দা থাকলেও পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনও পট বা সরা লক্ষ্মী গড়ছেন পটুয়ারা। লুপ্তপ্রায় হতে থাকা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ক্রেতাদের কাছে ন্যায্য মূল্য আশা করছেন শিল্পীরা। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বর্তমান প্রজন্মকে এই শিল্পকলায় আকৃষ্ট করতে সরকারি পরিকল্পনার দাবি তুলেছেন তাঁরা।
দুর্গোৎসব শেষ হতেই এবার ধন লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতেছে মানুষ। ইতিমধ্যেই মৃৎ শিল্পীদের তৈরি নানান রকমের লক্ষ্মী প্রতিমা বাজারজাত হচেছ। তেমনভাবেই পট কিংবা সরা লক্ষ্মী প্রতিমা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেছেন শিল্পীরা। পেটের তাগিদ সামান্য লাভ রেখেই তা বিক্রয় করা হচ্ছে। কিছু মানুষের চাহিদা অনুযায়ী জেলার কুমারগঞ্জ, গঙ্গারামপুর, বালুরঘাটের গুটি কয়েক পটুয়া জীবিকা নির্বাহ করছে কোনও রকমে। বালুরঘাট শহরের খিদিরপুর এলাকায় ৪টি থেকে ৫টি বাড়িতেই শুধুমাত্র পট প্রতিমা তৈরি হয়। একেকটি বাড়িতে খুব বেশি হলে ১৫০ থেকে ২০০টি প্রতিমা তৈরি করা হয়ে থাকে চাহিদা অনুযায়ী। উপায়হীন বয়স্করা ওই কাজে নিযুক্ত থাকলেও, তাঁদের বর্তমান প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। তাঁরা যুক্ত হয়ে পড়ছে অন্য পেশায়। শিল্পীদের আশঙ্কা, এমনভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে একটি সময় জেলাতে এই শিল্প লুপ্ত হয়ে যাবে। বালুরঘাট শহরের খিদিরপুর এলাকার কয়েক ঘর পটুয়াদের বসবাস। তাঁরা মূলত সব দেবতার প্রতিমা গড়েন পট আকারে। কিন্তু বিক্রয় বাজার অর্থাৎ ন্যায্য দাম না-পাওয়াটা একটা বড় সমস্যা এই শিল্পীদের। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সকলের বলেই দাবি তাদের।
পট শিল্পী রেখা পাল, নিতাই পাল, নিরেন পাল বলেন, কাঁচামালের দাম এবং আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা এই কাজ করে চলেছেন শুধুমাত্র পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। সঙ্গে রয়েছে এই শিল্পকর্মের প্রতি একটু ভালোবাসা। পেটের তাগিদে সামান্য লাভ চান তাঁরা। কিন্তু এবারে পটলক্ষ্মীর যা দাম উঠেছে তাতে পেট চালানো দায় হয়েছে। কারণ, পটের প্রতিমা বানাতে মাটি থেকে রঙ সবটাই কিনতে হয় চড়া দামে। একেকটি পটপ্রতিমা বাজারজাত করতে খরচ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। অথচ তার দাম উঠেছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যেই। আগুন বাজারে ওই লাভাংশ দিয়ে পেট চলেনা তাঁদের। স্বাভাবিকভাবেই পূর্বপুরুষদের শুরু করা এই কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। তবু প্রথা ও নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচাতে প্রৌঢ়রা এখন এই কাজ করছেন। কেননা অন্য প্রতিমায় অপটু তাঁরা। তবে খোলা বাজারে যা দাম ওঠে, সেই দামেই তাঁরা পাইকারি বাজারে ছেড়ে দেয় সরা বা পটের লক্ষ্মী। আগামীতে কী হবে তা এখন ভাবনার বিষয়। শিল্পীদের কথায়, তাঁদের বর্তমান প্রজন্ম এই সামান্য লাভে লক্ষ্মী কেন, অন্য কোন সরা বা পট প্রতীমা বানাতে চায়না। তাঁরা ঝুঁকে রয়েছে সাধারণ প্রতিমা গড়ার কাজে। একদিন ঐতিহ্যের এই শিল্পকর্ম হারিয়ে যাবে বলেই মনে করছেন এই সব শিল্পীরা।
প্রসঙ্গত, কালীঘাটের পট শিল্প পৃথিবী বিখ্যাত। পটুয়ারা কাগজের উপর প্রথম এই শিল্পকলা তৈরি করত। প্রখ্যাত শিল্পী জামিনী রায় মাটির ওপর সূচনা করেন পটকে। ধীরে ধীরে ওই শিল্প পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে পরে। এরপর থেকে এই কাজে যুক্তদের পটুয়া বলা হয়। দক্ষিণ দিনাজপুর-সহ উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু জেলা এবং বাঁকুড়া এবং বীরভূমের কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে পট দেব-দেবীর প্রচলন। শিব, দুর্গা, গণেশ ছাড়াও লক্ষ্মী দেবীকে রূপ দেওয়া হয়ে পট আকারে। ঘট ও মূর্তির পাশাপাশি পট লক্ষ্মীর পূজা করে আসছে বহু পরিবার। আজও বংশানুক্রমে পট লক্ষ্মী পূজা করা হয় বালুরঘাট-সহ জেলার বহু অঞ্চলে। চাহিদা অনুযায়ী এখানকার কিছু মৃৎ শিল্পী পট প্রতিমা গড়তে শুরু করেছিলেন অনেক বছর আগে।

