দীপাবলি ও কালীপূজা আলোর উৎসব। রাজ্য তথা দেশ জুড়ে ওই দিন প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতেই আলো ঝলমল করে ওঠে। যদিও অন্যের বাড়ি আলোতে ভরিয়ে তুললেও নিজেদের জীবনে নেমে এসেছে অমনিশার কালো আঁধার। আর সেই আঁধারে ডুবে যাচ্ছে তিলে তিলে হাওড়া শহরের হাতে গোনা কয়েকটি মাটির প্রদীপ তৈরির মৃৎশিল্পীদের জীবন।
আর মাত্র ৬ দিন বাকি। আর তারপরই সারা দেশ-সহ এই রাজ্যের বাসিন্দাদের গৃহ আলোর রোশনাইয়ে ঝলমলিয়ে উঠবে। চলতি মাসের ২৪ অক্টোবর ঘোর অমাবস্যায় অন্ধকারকে দুরে সরিয়ে আলো জ্বেলে মা কালী ও দীপান্বিতা লক্ষ্মীর আরাধনাতে ব্রতী হবে সনাতন সমাজ। কিন্তু যাঁদের হাত দিয়ে তৈরি এই মাটির প্রদীপ অন্যের আঙিনায় ঝলমল করে উৎসবকে আলোকিত করবে সেই মৃৎশিল্পীদের ঘরেই এখন অন্ধকার। আগে কালীপুজো এলেই ঘর আলো করতে মাটির প্রদীপের চাহিদাই থাকত বেশি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে গৃহস্থরা ঝুঁকেছেন তুলনায় সস্তা এবং বাহারি বৈদ্যুতিক আলোর দিকে। এই পরিস্থিতিতে কালীপুজোর মুখে জেলার কুমোররা। মাটির প্রদীপের কদর কমতে থাকায় এই কাজ ছেড়ে অনেকেই এখন অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন।
আলোর উৎসব তথা দীপাবলীতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মাটির প্রদীপের আলো। তবে প্রদীপের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে অনেকেই এবারে প্রদীপ তৈরি বন্ধ করে দিয়েছেন। মৃৎশিল্পীরা পুজোর নানা উপকরণের সঙ্গে মাটির তৈরি অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করছেন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতি বাজারে চলে আসায় প্রাচীন সেই মাটির প্রদীপ হারিয়ে যেতে বসেছে। বাজারে সেই প্রদীপের কম চাহিদা থাকায় প্রায় বন্ধের মুখে এই শিল্প। একদিকে মাটির দাম বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ছাই, কয়লার দাম। আর বর্ধিত দামে মাটির প্রদীপ কিনতে নারাজ ক্রেতারা। আর এই কাঁচামালের বর্ধিত দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ৫-৬ টাকা দামে বিক্রি করতে হচ্ছে প্রদীপ। তবে ক্রেতাদের কাছে তার চাহিদা নেই। সেই চাহিদাতে থাবা বসিয়েছে বাজারে চিনা বাল্ব ও নানান বাহারি আলোর টুনি বাল্ব। যার জেরে অনেক মৃৎ শিল্পী প্রদীপ তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও মরার উপরে খাঁড়ার ঘা হিসাবে সরষের তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রদীপের চাহিদা নেই বললেই চলে।
হাওড়ার ডাসি পাড়ার কুমোরপাড়াতে মৃৎ শিল্পী রাজেন্দ্র প্রজাপতি জানান, তিনি ৪০ বছর ধরে এই পেশাতে আছেন। বিগত দু বছর ধরে বাজারে মাটির প্রদীপের চাহিদা নেই। আটটি পরিবার এই এলাকাতে আছে। আগে এই সময় এক মাস আগে থেকে নাওয়া খাওয়ার সময় পাওয়া যেত না। এখন ক্রেতা ও বরাত পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এই বছর আর মাটির প্রদীপ তৈরি করছেন না তিনি। শুধু নিজের বাড়ির জন্য কিছু প্রদীপ বানাচ্ছেন। তিনি কটাক্ষ করে বলেন , এখন মাটির কোনও সন্মান নেই। চিনা টুনি তাঁদের মাটির প্রদীপের চাহিদা মেটাচ্ছে। মানুষ ওগুলোই সস্তা পেয়ে কিনছে। মাটির প্রদীপ উঠে যাবে না, তবে তার চাহিদা থাকবে না। পাশাপাশি প্রদীপ তৈরির কাঁচামালের দাম বারার জন্যও তাঁরা কম দামে তৈরি করতে পারছেন না। তাই প্রদীপ তৈরির সময় পেট চালাতে মাটির ভাঁড় তৈরি করছেন।
একই চিত্র মিশ্র পাড়াতেও। সেখানেও এই বছর মাটির প্রদীপ তৈরি করছেন না মৃৎ শিল্পীরা। জনৈক মৃৎ শিল্পীর স্ত্রী জানান, সাড়া বছর পরে এই পরবের সময় বিক্রি না হলে তাঁরা চিন্তায় পড়েন। মাটি থেকে কাঠ, কয়লা ও ছাইয়ের দাম বেড়েছে তার উপরে খাটনি রয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট টাকা শয়ে ক্রেতারা চাইছে প্রদীপ। কোথা থেকে দেবেন। তাই এই বছর মাটির প্রদীপ বানানো বন্ধ রেখেছেন তাঁরা। তাঁর অনুরোধ, সরকার যদি তাঁদের জন্য কোনও ব্যবস্থা নেয় তাহলে একটু সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারেন।
শিল্পীদের অনেকেই বলেন, সরকার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। তাহলে উৎপাদন বাড়িয়ে মহাজনের মাধ্যমে ভিনরাজ্যে প্রদীপ পাঠালে তুলনামূলকভাবে দাম অনেকটাই বেশি পাওয়া যাবে। তাঁরা চান, ফের গৃহস্থের পছন্দের তালিকায় উঠে আসুক মাটির প্রদীপ।
তবে সরকার আদৌ সাড়া দেবে কিনা অথবা আদৌ তাঁদের জীবনে দীপান্বিতায় প্রদীপের আলো ঝলমল করে উঠবে কবে তার উত্তর জানা নেই এই মৃৎশিল্পীদের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের বাড়িতে আলো জ্বালানোর প্রদীপ তাঁদের নিজেদের জীবনে জ্বলে তাদের ভাগ্যের আঁধার কবে কাটাবে তার দিকেই তাকিয়ে আছেন এই মৃৎ শিল্পীরা। এভাবেই স্বার্থক হয়ে উঠছে বাংলার প্রচলিত প্রবাদ বাক্য ‘প্রদীপের তলাতেই অন্ধকার’।