রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক রাজ্য বিজেপি সভাপতির, শুরু নয়া রাজনৈতিক তরজা

শনিবার সকালে আচমকাই রাজভবনে উপস্থিত হতে দেখা গেল বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে। প্রায় দু’ঘণ্টা রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে আলোচনা হয় বলেও সূত্রে খবর। এরপর রাজভবন থেকে বেরিয়ে এসে সুকান্ত মজুমদারের দাবি, ‘রাজ্যপালের সঙ্গে সদর্থক আলোচনা হয়েছে। রাজ্য জুড়ে হিংসার খবর আমরা তাঁকে জানিয়েছি। তিনি বলেছেন কোনওরকম হিংসা বরদাস্ত করা হবে না। হিংসামুক্ত রাজনীতি চান তিনি। এই নিয়ে অর্ডিন্যান্সও জারি করবেন বলেছেন। আমি তাঁকে আবেদন করেছি পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হিংসা, প্রহসন যাতে না হয়, সেদিকে একটু আলোকপাত করতে। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এর জন্য যা দরকার তিনি করবেন।’ তবে সুকান্ত মজুমদার এবং রাজ্যপালের এদিনের এই সাক্ষাৎ ঘিরে জল্পনা ছড়ায়। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বিজেপিকে বিদ্ধ করে জানান, আদতে এই সাক্ষাৎ আসলে ক্ষমা চাওয়ার কৌশল। একইসঙ্গে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক এও জানান, ‘আমাদের কাছে খবর আছে, সুকান্ত মজুমদার রাজ্যপালের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলেন।’একইসঙ্গে তাঁর সংযোজন,  শুভেন্দু অধিকারী মুখ দেখাতে পারছেন না। তবে বিজেপি রাজ্য সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে দু’ঘণ্টার মধ্যেই রাজভবন থেকে জারি করা হয় এক কড়া বিজ্ঞপ্তি।

প্রসঙ্গত, রাজভবনে বাজেট অধিবেশনের শুরুতেই রাজ্যপালের ভাষণ ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। সি ভি আনন্দ বোসের ভাষণের শুরুতে বিজেপির তরফ থেকে হায় হায় স্লোগান ওঠে। ‘গো ব্যাক’ বলা হয় রাজ্যপালকে। এছাড়াও একাধিকবার রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা যায় বঙ্গ বিজেপির তরফ থেকে। তবে এদিন একেবারে সামনে এল উলটো এক চিত্র।

এই প্রসঙ্গে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানান, ‘রাজ্য যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তেমন রাজ্যপালও দুর্নীতি মুক্ত পরিবেশ চান। এটা আর নতুন কি। সি ভি আনন্দ বোস তো সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট কথা বলেন। তাঁর আপ্ত সহায়কও আছে।’ আর এখানেই প্রশ্ন, ‘তাহলে সুকান্ত মজুমদার কি তাঁর নতুন মুখপাত্র নাকি? উনি এসে রাজ্যপালের কথাগুলো বলছেন কেন? আসলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে, সুকান্ত মজুমদার করজোড়ে রাজ্যপালের কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলেন। শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে সেদিন বিধানসভায় যে ধরণের অসভ্যতা হয়েছিল তারপর থেকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আর মুখ দেখাতে পারছেন না। আর সেই কারণেই রাজভবনে সুকান্ত তাঁকে নিয়েও আসেননি।‘

তবে সবকিছু জল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে ঘণ্টাদু’য়েক বৈঠকের পরেই রাজভবনের তরফে ‘কড়া বিবৃতি’ জারি করেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। এই বিবৃতিতে রাজভবনের তরফ থেকে জানানো হয়, গত দু’মাসের অভিজ্ঞতায় মূলত তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা দরকার। প্রথমত, ভারতের সংবিধানকে অক্ষুণ্ণ রাখা। দ্বিতীয়ত, আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা এবং তৃতীয়ত, বাংলার মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করা। নিজের তিনটি মূলমন্ত্রের কথা বলার পর পরই বিজেপি সভাপতির সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের ব্যাখ্যাও দেন রাজ্যপাল আনন্দ বোস। এই প্রসঙ্গেই রাজ্যপাল জানান, সুকান্ত তাঁর কাছে রাজ্যে দুর্নীতি ও বেনিয়মের পাশাপাশি পঞ্চায়েত নির্বাচনে আগাম সন্ত্রাসের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারই প্রেক্ষিতে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাজ্যপাল জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে যথা সময়ে ‘কার্যকরী ও সক্রিয়’ হস্তক্ষেপ করা হবে। নির্বাচনে হিংসার কোনও স্থান নেই এবং আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট যাতে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তা-ও নিশ্চিত করা হবে। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে শাসকদলের হিংসার কথা যে বিজেপি সভাপতিই তাঁকে জানিয়েছেন, তা-ও নিজের বিবৃতিতে উল্লেখ করে দিয়েছেন আনন্দ বোস।

এদিকে শনিবারের বিবৃতিতে বর্তমান রাজ্যপাল এও জানান, আচার্য পদ নিয়ে পুরনো নিয়মই বহাল রাখা হবে। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে মুখ্যমন্ত্রীকে বসানোর যে বিল রাজ্য সরকার বিধানসভায় পাশ করিয়েছিল, তা রাজভবনের সিলমোহর পাবে কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হল। প্রসঙ্গত, গত বছর বাদল অধিবেশনে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘আচার্য’ পদে বসানোর বিল পাশ করেছিল রাজ্য সরকার। সেই বিল ধনকড় জমানা থেকেই রাজভবনে আটকে। এই বিজ্ঞপ্তি রাজভবন থেকে জারি হওয়ার পরই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে বলতে শোনা যায়, ‘রাজ্যপাল ‘ট্র্যাকে’ আসছেন।‘ অর্থাৎ, ‘পথে’ আসছেন। যে ‘পথ’ তাঁরা চান।

রাজ্যপালের ওই বিবৃতির পর বিরোধী সিপিএমের নেতা সুজন চক্রবর্তী জানান, ‘এই রাজ্যপাল একদিন মুখ্যমন্ত্রীকে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের সঙ্গে তুলনা করেন! তার পরে আবার রাজ্যের বিষয়ে কড়া বিবৃতি দেন। উনি তো এই ভাবে নিজের পদটাকেই মর্যাদাহীন করে ফেলছেন। এক একদিন এক এক রকমের কথা বলছেন।’

এদিকে শনিবার কলকাতায় আসছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। তার সঙ্গে রাতে শুভেন্দু-সুকান্তের বৈঠক হওয়ার কথা। ওই বৈঠকেও রাজ্যপালকে নিয়ে কথা হতে পারে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। এখন দেখার, রাজ্যপালের বিবৃতির পরে রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজভবনের সম্পর্ক কেমন দাঁড়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five + eleven =