দেশের হয়ে সোনা জিতেছে ছেলে, গর্বে বুক ভরেছে অচিন্ত্যের মা পূর্ণিমার

রাজীব মুখোপাধ্যায়, হাওড়া

টিভির পর্দায় ছেলে। চলছে কমনওয়েলথ গেমসের ভারত্তোলনের প্রতিযোগিতা।একটা একটা ধাপ পার হচ্ছে। আর মায়ের বুকটা যেন উত্তেজনায় ধরফড় করছে। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। টিভির পর্দায় বিজয়ী হিসেবে নাম ঘোষণা হল অচিন্ত্য শিউলির।আনন্দে ফেটে পড়লেন হাওড়ার দেউলপুরের বাসিন্দারা। ছেলের গলায় পরানো হচ্ছে মেডেল, আর অশ্রু বিসর্জন করছেন মা। এ চোখের জল বড় আনন্দের। বড্ড খুশির।

লড়াই। সেই কবে থেকেই চলছিল অচিন্ত্যর ও তাঁর পরিবারের। দারিদ্র, অনটন, পাহাড় প্রমাণ বাধা কোনও কিছুই দমাতে পারেনি অখ্যাত গ্রামের ছেলে অচিন্ত্য শিউলিকে (Achinta Sheuli)। পারেনি বলেই সেই ছেলে এ বছর কমনওয়েলথ গেমস-এ ভারোত্তোলনে (Weightlifting) ৭৩ কেজি বিভাগে সোনার মেডেল জিতলেন। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ৩১৩ কেজি ওজন তুলে গড়লেন রেকর্ড। শুধু নিজের গ্রামকেই প্রচারের আলোয় নিয়ে এলেন তা নয়, মুখ উজ্জ্বল করলেন ভারতেরও।

তবে এ জয়ের গল্প হার মানাতে পারে যে কোনও ছবির চিত্রনাট্যকেই। হাওড়ার পাঁচলার দেউলপুরে অচিন্ত্যর বেড়ে ওঠা। বাবা ভ্যান চালাতেন। সেই টাকায় নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই ভারত্তোলনের ইচ্ছে, দেশের হয়ে পুরস্কার জেতার স্বপ্ন অনেকটাই বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল সেদিন শুধু গ্রামবাসী কেন, আরও অনেকের কাছে।ভারোত্তলেনর জন্য প্রশিক্ষণ তো আছেই, তার ওপর সুষম খাবার, পুষ্টি ছাড়া তা সম্ভব নাকি! কিন্তু যে পরিবারে ভালোভাবে খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হয় সেখানে সুষম খাবার দূর অস্ত। তবে হাল ছাড়েননি অচিন্ত্য। চেষ্টা করেছেন। এভাবেই যখন চলছিল তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বাবার আচমকা মৃত্যু। তখন তার বয়স মোটে ১১। অচিন্ত্যকে অনেক কষ্ট তো করতে হয়েছেই। তেমনই ভাইয়ের জন্য কষ্ট করেছেন দাদাও। ধার করে বাবার শেষকৃত্য করেন দুই ছেলে।

তারপরের লড়াই আরও কঠিন। তবে এই জয় সেই কষ্টকেই লাঘব করল মনে করছেন অচিন্ত্যর মা ও দাদা। পূর্ণিমা শিউলি জানালেন, ছেলেদের দারিদ্রের মধ্যে অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। এখন গোটা দেশ তাঁর ছেলেকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে তাতে তিনি খুব খুশি।অচিন্ত্যের সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়ে ট্যুইট করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। ভিডিও বার্তায় অচিন্ত্যকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

কেমন ছিলেন ছেলেবেলায় অচিন্ত্য? মা জানালেন, ছোট থেকে অচিন্ত্য দুষ্টুমি করত। তবে খেলা ও শরীর চর্চার ওপর বরাবরই টান ছিল। জলে ভেজানো মুড়ি খেয়ে স্কুলে চলে যেত। স্কুলছুটির পর শরীর চর্চা করত। ছেলে যে একদিন এতটা বড় হবে, ভাবতেই পারেননি তিনি। তাই আজ ভীষণ গর্ব হচ্ছে।

অচিন্তের দাদা অলোক শিউলি জানান, তিনি একটি কোম্পানিতে মাল তোলা ও নামানোর কাজ করতেন। সকাল ছটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধেয় ফিরে ফের জরির কাজ নিয়ে বসতেন। সামান্য রোজগারে অচিন্ত্যকে বড় করেছেন।এই দীর্ঘ লড়াইয়ে সরকারি সাহায্য সেভাবে না মেলায় আক্ষেপ অচিন্ত্যর মা, দাদা দু’জনের গলাতেই। অলোকের আক্ষেপ, যাঁরা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত তাঁদেরকে নিয়েই সরকার ব্যস্ত। যারা এখন উদীয়মান ক্রীড়াবিদ তাঁদের নিয়ে কোনও মাথাব্যথা সরকারের নেই। পরিবারের দাবি, ২০১৯ সালে খেলতে যাওয়ার সময়ে একবার সামান্য সরকারি সাহায্য পেয়েছিল। কিন্তু আর দীর্ঘ লড়াইয়ে সাহায্য মেলেনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আজকের দিনটি দেখার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার, লড়াই করতে হয়েছে।

অচিন্ত্যর প্রশিক্ষক অষ্টম দাস অবশ্য জানালেন, তিনি আশাবাদী ছিলেন। একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন অচিন্ত্য এবারে সোনা পাবে বলে। অচিন্ত্যর দিন বদলের গল্প শুরু হয় সেনা বাহিনীর শিবিরে যোগ দিয়ে।২০১৪-১৫ তে পুণে সেনাবাহিনীর ট্রায়াল চলছিল। সেখানেই ছ’জনকে নিয়ে গিয়েছিলেন অষ্টম। তাঁদের মধ্যে নির্বাচিত হন অচিন্ত্য। স্বপ্নপূরণের পথ একটু একটু করে প্রশস্ত হতে থাকে।

আর এতকিছুর পর কী বলছে অচিন্ত্যর গ্রাম?  গভীর রাত পর্যন্ত দেউল গ্রামে অচিন্ত্যর পড়শিরা একসঙ্গে টিভিতে পাড়ার ছেলের ঐতিহাসিক জয় দেখেছন।অপেক্ষা করছেন তাঁরা কবে অচিন্ত্য ফিরবেন। সকলে মিলে সংবর্ধনা দেবেন তাঁকে।আর অচিন্ত্যর মা অপেক্ষা করছেন কবে ছেলেটাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরবেন।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − 13 =