জলঘড়ির সময় দেখে অনুষ্ঠিত হয় খানাকুলের মিতবাড়ির দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজো

মহেশ্বর চক্রবর্তী

ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলেও সেই জমিদারী প্রথা আর বাংলার বুকে দেখা যায় না। তবে এখনও ভারতের তথা বাংলার বহমান ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা দেখা যায় জমিদার বাড়ির দুর্গাদুজোর রীতিনীতিতে। বয়সে প্রবীণ হুগলির খানাকুলের সেনহাটের মিত্র জমিদারবাড়ি। সোনালি দিন গিয়েছে, এখনও আভিজাত্যের অহংকার অমলিন রয়েছে মিত্রবাড়িতে। ঐতিহ্যের বয়স প্রায় ৫০১ বছর। ™রিবারের সনাতন রীতিনীতি মেনে আজও পালিত হয় দুর্গোৎসব। আজও অকাল বোধনে যষ্ঠীর দিন কুলদেবতা ভগবান রঘুনাথ জিউয়ের অকাল রথের রশিতে টান ধরেন পরিবারের সদস্যরা। যষ্ঠীর দিন রথে করে দুর্গা মন্দিরে আনা হয় আর দশমীর দিন রথে করে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার স্থায়ী মন্দিরে। এই অকাল বোধনে অকাল রথের রশি ধরেন পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি আজও জলঘরির সময় দেখে অনুষ্ঠিত হয় মিতবাড়ির দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজো। প্রায় ৫০০ বছর আগে এই সব আধুনিক যন্ত্র তো কল্পনাতেও ছিল না। সময় দেখার একমাত্র ভরসা ছিল জলঘড়ি। মিত্রবাড়ির সদস্যদের দাবি, এই জলঘরিটি উপহার হিসাবে মিত্রবাড়িতে এসেছিল বর্ধমানের রাজার কাছ থেকে। জল ঘড়ি বলতে ছোট একটি তামার বাটি। যাকে জমিদার বাড়ির ভাষায় তাঁবু বলা হত। তাতে ছোট একটি ছিদ্র থাকত। এই তাঁবুকে জলের মধ্যে ভাসিয়ে দিলে ছিদ্র দিয়ে জল প্রবেশ করতো। পূর্ণ তাবু এক সময় জলের ভারে ডুবে যায়। আবার তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই ডুবে যাওয়ার পদ্ধতিটি ২৪ মিনিট ছাড়া হয়। এই ডুবে যাওয়াকে এক একটি দণ্ড বলা হয়। যতবার তাঁবুটি ডুবছে ততবার সময় হিসাব করা হয়। সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময় থেকে তাঁবু ভাসানো হয়। কখন থেকে শুরু হবে তা ঠিক হয় সন্ধি পুজোর সময় অনুযায়ী। সকালের পর সন্ধি পুজো হলে সূর্যোদয় থেকে আর সন্ধ্যার পর সন্ধিপুজো হলে সূর্যাস্ত থেকে তাঁবু ভাসানো হয়। নিদিষ্ট একজন আচার্য ব্রাহ্মণ্য নাকি এই জলঘড়ি চালান। এই রকম অলৌকিক ঘটনা আরও রয়েছে বলে দাবি মিত্র পরিবারের সদস্য ডাক্তার সুকন্যা মিত্রের। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সন্ধি পুজোর সময় জমিদারবাড়ির নিমগাছে এক জোড়া শঙ্খচিল এসে বসত। কিন্তু আচমকা প্রচণ্ড ঝড়ে নিম গাছটি ভেঙে পড়ে। তাই গাছে আর শঙ্খচিল না দেখা গেলেও সন্ধি পুজোর সময় নীল আকাশে দুটো শঙ্খচিল ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। পারিবারিক ভাবে জমিদার বাড়ির পুজো হলেও বর্তমানে প্রায় ৩৬ ঘর শরিখ রয়েছে। প্রায় পাঁচশো বছর আগে বর্ধমান রাজার অধীনে এই জমিদারবাড়ির পত্তন করেছিলেন নন্দকিশোর মিত্র। তিনিই এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। আগে সন্ধ্যি পুজোর সময় মেষ বলি হত এখন নিখুঁত কালো ছাগ বলি হয়। আগে রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী কামান দাগা হত। এখন হয় না। সাবেক কালে কেরোসিনের হ্যাচাক ও ডেলাইটের বদলে ইলেক্টিকের আধুনিক লাইট দিয়ে মণ্ডপ ও জমিদার বাড়ি সাজানো হয়। এখন আর সানাইয়ের সুর শোনা না গেলেও ঢাক ও কুড়কুড়ির বাজনা বাজে। নবমীর দিন ১১টা পাঁটা বলি হয়। বিজয়ারদিন বাড়ির মহিলারা সিঁদুর খেলায় অংশ নেন। তারপর শোভা যাত্রা করে খানাকুলের রাজহাটি বাজারের বিশালক্ষ্মী মায়ের মন্দিরে মা দুর্গাকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে দুই দেবতার সাক্ষাৎ হয়। সেখান থেকে বিসর্জন ঘাটে এনে বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে দুর্গা নাম লিখে বিসর্জন দেওয়া হয়। আগে তালপাতার লেখা হতো এখন কাগজে দুর্গা নাম লেখা হয়। সবমিলিয়ে সাবেকিয়ানা ও প্রাচীনত্বের নিরিখে সেন রাজাদের সমসাময়িক এই মিত্রবাড়ির দুর্গাপুজো। তাই বারোয়ারী পুজোর ভিড়ের মাঝেও সবসময়েই আলাদা জায়গা তৈরি করে নেয় মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 + four =