লোকসভা ভোটে কার্যত ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির। তা নিয়ে চর্চা চলছে বিভিন্ন মহলে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বিপর্যয়, কোথায় খামতি তা নিয়ে। এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, নির্বাচনে তৃণমূল বিগত কয়েক বারের মতো বাঙালি অস্মিতাকেই হাতিয়ার করেছিল। আর বিজেপির তাস ছিল হিন্দুত্ব। ফলে মেরুকরণের ভোট অঙ্ক বাংলায় মেলাতে পারেনি পদ্ম শিবির। এবার ভোটের ফল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বুধবার সায়েন্স সিটিতে বসে রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠক।
সায়েন্স সিটির এই বৈঠক থেকে পরাজয়ের দায় ঝেড়ে ফেলতে দেখা গেল বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। তাঁর কথায়, ‘আমি বিরোধী দলনেতা, সংগঠনের দায়িত্বে আমি নেই।’ পাশাপাশি রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি জানান কীভাবে প্রতিমুহূর্তে নির্যাতিত কর্মীদের পাশে দাঁড়ান তিনি। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বিজেপির পরাজয়ের দায় ইঙ্গিতে সংগঠনের দায়িত্বে থাকা নেতা অর্থাৎ সুকান্তর দিকে ঠেলে দেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু।
এর পাশাপাশি শুভেন্দু এও বলেন, ‘আমার সংগঠন নিয়ে যা বলার ছিল সেটা দিল্লিতে বলে এসেছি সুনীল বনসলকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি জানিয়ে এসেছি কীভাবে বাংলাকে বাঁচানো যায়।’ বারবার কর্মীদের জন্য রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছেন সেকথাও তুলে ধরেন। দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কীভাবে এগোতে হবে তা নিয়েও মন্তব্য করেন শুভেন্দু। এদিনের সভায় সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘বিজেপি বাংলা থেকে হারিয়ে যায়নি।’ মাটি ফেরানোর লড়াইয়ের ডাকও দিলেন তিনি। একইসঙ্গে তাঁর বিস্ফোরক বার্তা, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ বলব না, বন্ধ কর। রাষ্ট্রবাদী মুসলিম বলব না, সংখ্যালঘু মোর্চা চাই না, বলব না।’ সায়েন্স সিটিতে বিজেপির মহাবৈঠকে বিস্ফোরক মন্তব্য শুভেন্দু অধিকারীর। শুভেন্দু স্পষ্ট বললেন, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ বন্ধ কর। রাষ্ট্রবাদী মুসলিম চাই না। সংখ্যালঘু মোর্চা চাই না। যে আমাদের সাথে, আমি বা আমরা তাদের সাথে। ভোটের আগে অনেক বলেছি রাষ্ট্রবাদী মুসলিম। কিন্তু আর নয়। যারা আমাদের সঙ্গে থাকবে, তাদের সঙ্গে আমরা থাকবো।’
এই বৈঠকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এদিন এক বিস্ফোরক বক্তব্যও রাখতে দেখা যায় শুভেন্দুকে। শুভেন্দু বুধবার বলেন, ‘বিজেপি বাংলায় অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ভোট পেয়েছে। তৃণমূলের জিহাদি জঙ্গিরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে উনিশের পর বুথ স্তরের সংগঠনকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল অত্যাচার করে। এক লক্ষের বেশি আমাদের বুথে বসা ছেলে পালিয়ে ছিল রাজ্য ছেড়ে। তারপর আমরা চেষ্টা করে তাদের রাজ্যে এনেছি। সফল নবান্ন অভিযান করেছি, বিধানসভার ভিতরে বাইরে লড়াই করেছি ।’
শুভেন্দু এদিন এও বলেন, ’চুলচেরা বিশ্লেষণের দরকার আছে । উত্তরবঙ্গ, বাঁকুড়ার আসন হারব এ আমি ভাবিনি।’ ভোটের আগে ব্রিগেডে ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ’ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। ঘোষিতভাবে তা বিজেপির কর্মসূচি না হলেও, বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে। এদিনের এই বৈঠক থেকে শুভেন্দুর বিস্ফোরক অভিযোগ, ‘৫০ লক্ষ হিন্দুকে ভোট দিতে দেয়নি তৃণমূলের গুণ্ডারা।’
পাশাপাশি শুভেন্দু এদিন এও জানান, ‘বিজেপিতেই রিটায়ারমেন্ট’। একইসঙ্গে এদিন সায়েন্স সিটির অনুষ্ঠানে লোকসভা নির্বাচনে বঙ্গে বিজেপি যে ফলাফল করেছে তার প্রেক্ষিতে ‘চুলচেরা বিশ্লেষণ’ প্রয়োজন রয়েছে, তা স্বীকার করেন শুভেন্দু। রাজ্যের বিরোধী দলনেতার বক্তব্য, ‘আমি জাতীয়তাবাদী পরিবার থেকে এসেছি। মুকুল রায়ের মতো সব কেড়ে নেওয়ার পর বিজেপিতে আসিনি। আমি সব ছেড়ে দিয়ে বিজেপিতে এসেছি। বিজেপি এবং সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি, রাষ্ট্রবাদ, এখানেই আমার রিটায়ারমেন্ট হবে। এটুকু আমি আপনাদের কাছে কমিটমেন্ট করতে চাই।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে বঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন পাওয়ার নেপথ্যে অন্যতম ফ্যাক্টর মুকুল রায় ছিলেন, দাবি রাজনৈতিক মহলের। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল সামনে আসার পর থেকেই ফের তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। দিলীপ ঘোষকে মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে বর্ধমান দুর্গাপুরে পাঠানো, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী কারা হবেন, তা নির্বাচনে দলে ‘খামতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলছিল বিজেপির অন্দরেই। সেই সময় শুভেন্দুর এই মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে এদিন শুভেন্দুর মন্তব্য শুনে রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলেন, ‘এটা কি ভোটে ভরাডুবির দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা?’ কিন্তু, সবকা কা সাথ, সবকা বিকাশ তো প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখের স্বীকৃত স্লোগান। তাহলে কি শুভেন্দু অধিকারী সোচ্চারে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতার দেখানো পথের পথের বাইরে হাঁটতে চাইছেন? এতে করে কি বাংলায় নির্বাচনী ভাগ্য ফিরবে পদ্ম-পার্টির, প্রশ্ন গেরুয়া শিবিরেরই অন্দরে।