– রাজীব মুখোপাধ্যায় সাঁকরাইলের জমিদার বাড়ি পালবাড়ির দুর্গাপুজো প্রায় দুশো বছর ৷ এখানে বাড়ির কন্যা রূপেই পূজিত হন দেবী দুর্গা। অন্যান্য জমিদার বাড়ির প্রাচীন পুজোগুলি যেখানে অতীতের জৌলুস হারিয়েছে, পাল বাড়ির পূজাতে এখনও বেশ জাঁকজমক করেই হয় দেবীর আরাধনা।
পাল বাড়ির দুর্গাপুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে, রথের দিন হয় কাঠামো পুজো। মহালয়ের পরদিন প্রতিপদ থেকে ঘট পুজো শুরু, নিয়ম করে চণ্ডীপাঠ ষষ্ঠীতে হয় বোধন, পাল বাড়ির রীতি অনুযায়ী দশমীর দিন সিঁদুর খেলা হয়-না সিঁদুর খেলা হয় মহা অষ্টমীর দিন।
পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে ৷ অষ্টমীর তিথিতেই চলে সিঁদুর খেলা আর নবমীর তিথি শেষ হওয়ার আগে অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পুজো। অভিনবত্বের সাবেকিয়ানা ও ঐতিহ্য বুকে নিয়েই এভাবেই কয়েক শতক ধরে চলছে হাওড়ার আন্দুলের পাল বাড়ির দুর্গাপুজো। এখানে দেবীকে বাড়ির মেয়ের মেয়ে ‘উমা’ বলেই পুজো করা হয়। আর প্রতি বছর সর্বত্র যখন চলে সন্ধিপুজোর ক্ষন। সেই সময়েই এই বাড়িতে চলে সিঁদুর খেলার অনুষ্ঠান। যার পেছনে রয়েছে এই পরিবারে ঘটে যাওয়া এক হৃদয় বিদারক কাহিনী।
এভাবেই গুটি গুটি পায়ে কেটে গিয়েছে প্রায় দু’শো বছর । প্রতি বছর হাওড়ার সাঁকরাইলের রাজগঞ্জে পালবাড়িতে মেয়ে উমা আসেন পুজো নিতে। প্রায় একশো নব্বই বছরের বেশি সময় ধরে এই বাড়িতে দেবী দুর্গা পূজিত হয়ে আসছেন মেয়ে উমা রূপে ।
এই বাড়ির প্রাণপুরুষ ছিলেন রাজা রাম পাল । তিনি হাওড়ার আন্দুলের রাজবাড়ির দেওয়ান ছিলেন । ভাল কাজের জন্য রাজার থেকে ওই এলাকায় জমিদারি পান । সেই সময় রাজগঞ্জে গঙ্গার পাড়ে বাড়ি তৈরি করেন । কিন্তু হঠাৎ ভূমিকম্প এবং প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে গঙ্গার গ্রাসে তলিয়ে যায় সেই বাড়ি । এরপর ১৮৫৭ সালের পর আবার তৈরি হয় বাড়ি এবং নাট মন্দির । দ্বিতীয়বার এই বাড়ি তৈরি হয় প্রায় একশো নব্বই বছর আগে । রাজা রাম পালের ছেলে রামধন পাল সেই বাড়ির অনতিদূরে তৈরি করেন নতুন জমিদার বাড়ি, সঙ্গে ঠাকুর দালান । নিজের ছেলের নামে তৈরি হওয়া বাড়ির নাম দেন ললিত লজ। বাড়ির প্রবেশ দ্বারের উপরে আজও দেখা মেলে বাড়ির নামকরণ।
সেই সময় থেকেই পালবাড়িতে দুর্গাপুজো দিয়ে মূর্তি পুজো শুরু হয়, যা আজও সমান ঐতিহ্য বহন করে আসছে ৷রাম পালের দুই ছেলে আর দেওয়ানি করেননি । নফরচন্দ্র পাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে প্রথমে চাকরি ও পরে ইঁটের ব্যবসা শুরু করেন । এলাকার প্রচুর ইঁটভাটা তৈরি করে রেলের বিভিন্ন ডিভিশনে ইঁট সরবরাহ করতে শুরু করেন । এছাড়াও অন্যান্য বহু ব্যবসা করতে থাকেন । সেই সময় থেকেই পালেদের আর্থিক প্রতিপত্তি শুরু হয় । পালবাড়ির দুর্গাপুজোও জমজমাট হতে থাকে ৷ জন্মাষ্টমীর দিনে কাঠামো পুজোর মাধ্যমে এই বাড়িতে ঢাকে কাঠি পড়ে ৷ মহালয়া থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ । বাড়ির মহিলারা পুজোর সমস্ত কাজে হাত লাগান । অষ্টমীতে তৈরি হয় বিশেষ ভোগ, যা গোটা গ্রামের মানুষকে বিতরণ করা হয় । এই বাড়ির বিশেষত্ব হল, এই বাড়িতে অষ্টমীর দিনেই সিঁদুর খেলা হয় । এই রীতির প্রচলন হয় অতীতের এক অঘটনের কারণে । বাড়ির বড় ছেলে ললিতচন্দ্র পাল মাত্র ১৮ বছর বয়সে অষ্টমীর দিনেই মারা যান । তাঁর মৃতদেহ বাড়িতে রেখেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সম্পন্ন করা হয় অষ্টমী, নবমী ও দশমীর পুজো ৷ তারপর মৃতদেহ সৎকার করা হয় ৷ সেই থেকে আজ অবধি পালবাড়িতে অষ্টমীর দিনেই চলে সিঁদুর খেলার প্রথা ৷প্রায় দুশো বছর পরও সাঁকরাইলের পালবাড়ির দুর্গাপুজো চলছে বেশ জাঁকজমক করেইএখানে মায়ের রূপ চিন্ময়ী ৷ একচালায় সপরিবারে মায়ের অধিষ্ঠান । দশমীতে বাড়ির ছেলে এবং গ্রামের ছেলেরাই মাকে কাঁধে করে বাড়ির সামনে গঙ্গায় নিরঞ্জন দেন । তবে পুজোর এই ক’টা দিন জাঁকজমক ও আত্মীয়-পরিজনের কোলাহলে গমগম করে ওঠে গোটা বাড়ি । দেশ-বিদেশ থেকে আসেন আত্মীয়রা । পালবাড়ির পুজোয় জাঁকজমকে এখনও কোনও রকম ভাটা পড়েনি । পরবর্তী প্রজন্ম আর্থিক সমস্যার সম্মুখীনও হয়নি কারণ নফরচন্দ্র পাল ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি । তিনি অনুভব করেছিলেন বংশানুক্রমে বাড়িতে পুজো বজায় রাখতে হলে প্রয়োজন বিশেষ আর্থিক ব্যবস্থার । তাই বাড়ির পুজো চালানোর জন্য বেশ কিছু সম্পত্তি কেনেন ও দলিলের মাধ্যমে তা নির্ধারিত করে দিয়ে যান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য । পালবাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তি থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই গৃহদেবতা শ্রীধরজী-সহ দুর্গা, কালী ও লক্ষ্মীপুজোর সমস্ত ব্যয় বহন করা যায় । এভাবেই দ্বিশতবর্ষ ধরে বংশ পরম্পরায় সাবেকিয়ানায় উমা পূজিত হয়ে আসছেন এই পালবাড়িতে ।
ষষ্ঠী থেকে দশমী অব্ধি বাড়িতে নিরামিষ খাওয়া প্রচলিত হয়ে আসছে। দেবীর প্ৰতিমার ঘটের সুতো কাটার পরেই নিরামিষ খাওয়া দাওয়া করা হয়। তাঁদের পূর্ব পুরুষদের দুরদর্শীতার কারণে যে ট্রাস্ট তারা তৈরী করে গেছিলেন সেই ট্রাস্টের আয় থেকেই পাল বাড়ির নিত্যপুজো থেকে দুর্গাপুজো সমস্তটাই চলছে কয়েকশো বছর ধরে তাই পরিবারের সদস্যদের আর্থিক অনুদান এতে সেরকম নেই বললেই চলে।
পুজোর পাঁচটি দিন পরিবারের সদস্য ও এলাকার মানুষের সকলের পাত পড়ে এই পাল বাড়িতেই। সকলের উপস্থিতিতে আজও কয়েক শতকের ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানা বুকে নিয়ে অমলিন হয়ে উঠেছে পাল বাড়ির মেয়ে দেবী ‘উমা’র আরাধনা।