সুস্মিতা মণ্ডল
দাদা ম্যাসাঞ্জোর যাওয়ার রাস্তাটা কোনদিকে?
শেওড়াকুঁড়ি মোড় থেকে বাঁদিকে নিতে হবে। তারপর সোজা…।
উত্তর আসতেই ছুটল গাড়ি। বীরভূমের শেওড়াকুঁড়ি মোড়ের ব্যস্ততা পেরিয়ে গাড়ি খানিক এগোতেই বদলাতে থাকল দৃশ্যপট।বাড়ছিল সবুজ। রাস্তার পাশে বাড়িগুলোতেও তখন বদলের ছোঁওয়া। কোথাও টিনের চালার ঘর, কোথাও ছোটখাটো পাকা বাড়ি। মেন রাস্তাতেই চড়ে বেড়াচ্ছে ছাগল।
সেসব দেখে সকলেরই মনে প্রশ্ন জাগল তবে কি ঝাড়খণ্ড ঢুকে গেলাম নাকি! কিন্তু না ‘পিকচার’ তো তখনও বাকি ছিল। কালো পিচের মোলায়েম রাস্তা। দুরন্ত গতিতে ছুটছে গাড়ি।কিন্তু এ কী দেখছি? কোথা থেকে রাস্তার দু’পাশে শালের জঙ্গল শুরু হয়েছে। বর্ষার মরশুমে তা যেন আর সবুজ-সতেজ। ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের ছবির মতো। সেই জঙ্গল শেষ হলে শুরু হল টিলা। তারপর আস্তে আস্তে ছোটখাটো পাহাড়। কোথাও তালগাছ, কোথাও ঝোপঝাড়। সেই সবুজ পাহাড়ের পিছনে মেঘলা আকাশ তৈরি করেছে কনট্রাস্ট।
কখনও চড়াই, কখনও উতরাই। বীরভূম ছেড়ে গাড়ি তখন ঝাড়খণ্ডে। রাস্তার পাশে গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বিশাল জলাধার। গাড়ি আরও এগোতেই চোখে পড়ল বেশ উঁচু সবুজ টিলার ওপর একটা বাংলো। এক্কেবারে ড্যামের গায়ে। সেটা দেখে হতাশ হতে হল, কারণ, চেষ্টা করেও এ যাত্রায় সেচ দপ্তরের মূয়ারাক্ষী ভবনের বুকিং মেলেনি। লোকশনটা যে অসাধারণ সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধে ছিল না। ময়ূরাক্ষী ভবন পেরিয়ে আরও একটু গিয়ে গাছ-গাছালিতে ঘেরা টিলার ওপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুব আবাস। সেটাই ছিল এবারের ঠিকানা। ড্যামের গায়েই যুব আবাস।পজিশনের দিক দিয়ে এটাও বেশ। ছিমছাম, সুন্দর। আর লোহার প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে আবাসের ছাদে উঠলে চোখে পড়ে চারপাশের সুন্দর ভিউ।
ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর তৈরি হয়েছে ম্যাসাঞ্জোর ড্যাম।রয়েছে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প। এই জলাধারের সৌন্দর্য অদ্ভূত।চারদিকে ছোট, বড় ঢেউ খেলানো টিলা।তারই ওপর বেড়ে উঠেছে জঙ্গল। বৃষ্টির জল পেয়ে সেগুলো ঘন সবুজ, সতেজ। বর্ষায় জলে টইটম্বুর ম্যাসাঞ্জোর ড্যাম যেন ছবিতে আঁকা কোনও সুন্দর ছবি।আকাশে চলছে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। তার ছায়া এসে পড়েছে ড্যামের চারপাশের টিলাগুলোতে। হাওয়া আঁকিবুঁকি কাটছে ম্যাসাঞ্জোরের জলাধারের স্বচ্ছ জলে।মনে হল, প্রকৃতির এই রূপের টানেই তো ছুটে আসা।এই ভালোলাগাটুকুই আগামী কয়েকদিনের রসদ হয়ে থাকবে।
বর্ষায় উইকএন্ড ট্রিপের প্ল্যান করলে, কলকাতার কাছকাছি ম্যাসাঞ্জোর ড্যাম চলে আসা যায় অনায়াসেই। বিশেষত ভিড়ভাট্টাহীন উইকএন্ড ডেস্টিনেশন চাইলে তো বটেই!
যুব আবাসের ঠিক নীচটায় নেমেই একপাশে ড্যামের ওপর চলে গিয়েছে লম্বা সেতু। সেটা যে পড়ন্ত বিকেলে এক অনন্য সাধারণ ভিউ পয়েন্ট হয়ে ওঠে বলার অপেক্ষা রাখে না। সূর্যের ওপর মেঘের স্তূপ। সেই মেঘের ফাঁক ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে আসছে রবির ছটা।যেদিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল।আর জলকে পরম মমতায় ঘিরে রয়েছে সারি সারি টিলা।
যুব আবাস থেকে ২ কিলোমিটার মেন রাস্তা ধরে গেলেই বোটিং পয়েন্ট। সেখানে মাথা পিছু ১০০টাকার বিনিময়ে বোটিং করে সাক্ষী হওয়া যায় এক মনে রাখার মতো বিকেলের। বোটিং পয়েন্ট ছেড়ে মিনিট ৫-এক হাঁটলে চলে গেছে এক লম্বা ব্রিজ। সেই ব্রিজ থেকেই একদিকে দৃশ্যমান জলাধার।অন্য দিকে, জলের অঝোর ধারা, দুধ সাদা ফেনা তুলে সশব্দে ক্যানালে ঝরে পরা। কী তার রূপ। তারই মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া।কী যে সুন্দর তার রূপ।
না এ জায়গায় নামী-দামি হোটেল নেই। নেই আধুনিক কোনও রেস্তোরাঁ। খেতে চাইলে
জুটবে ডিম টোস্ট, মুড়ি তরকারি অথবা আটার পুরী সঙ্গে ছোলার সবজি।নিতান্ত সাদামাঠা জায়গার সঙ্গে প্রকৃতিও বড় মিলেমিশে গেছে। তবু বর্ষায় ম্যাসাঞ্জোরের হাতছানি অস্বীকার করা অসম্ভব।
কীভাবে যাবেন- ট্রেনে সিউড়ি গিয়ে দুমকাগামী বাস ধরে ম্যাসাঞ্জোর পৌঁছনো যায়।
সড়কপথেও বীরভূমের ওপর দিয়ে ম্যাসাঞ্জোর যাওয়া যায়। ম্যাসাঞ্জোর যাওয়ার পথে পশ্চিমবঙ্গের দিকে পড়ে তিলপাড়া ব্যারেজ।
থাকবেন- সেচ দপ্তরের বাংলো আছে ময়ূরাক্ষী ভবন। আছে পশ্চিমবঙ্গ যুব আবাস। আর ঝাড়খণ্ড ট্যুরিসমের একটি থাকার জায়গা আছে, ময়ূরাক্ষী রিসর্ট।