শুক্রবার কলকাতা পুরসভার বাজেট পেশ করতে চলেছেন মেয়র ফিরহাদ

অর্থসঙ্কট রয়েই গেছে কলকাতা পুরনিগমে। এদিকে গত অর্থবর্ষের বরাদ্দ করা টাকার উপরে এমবার্গো তোলা যায়নি। আর এই টানাটানির আর্থিক টানাটানির মধ্যেই সামনের শুক্রবার ফের বাজেট পেশ করতে চলেছেন কলকাতা পুরনিগমের মেয়র ফিরহাদ হাকিম। এদিকে কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কার্যত চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক বাজেট পেশ করেন মেয়র ফিরহাদ। কলকাতা পুরসভায় একাধিক ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় যাতে বাড়ানো যায় সে সম্পর্কেও বক্তব্য পেশ করেন তিনি। তবে বাস্তবে ছবিটা আলাদা। সূত্রে খবর মিলছে, যে হারে সম্পত্তি কর আদায় হয়েছে, সেই ধরনের আদায় অন্যান্য খাত থেকে হয়নি।

এই বাজেট পেশের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই বাজেট খরচের উপরে এমবার্গো জারি করেন তিনি। সঙ্গে নির্দেশ দেওযা হয়, পুর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ( কোড নং-৪০০) এবং স্থায়ী সম্পদ ( কোড নং-৮০০) তৈরির জন্য যে অর্থ বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে, তার মধ্যে ৬০ শতাংশ টাকার প্রাথমিক অনুমোদন কোষাগার থেকে দেওয়া হবে। বাকি ৪০ শতাংশ টাকা আপাতত আটকে রাখা হচ্ছে। বরাদ্দকৃত ৬০ শতাংশ টাকায় বিভাগীয় কাজগুলি সম্পাদন করে তার যাবতীয় নথি জমা দিলেই বাকি টাকা অনুমোদন করা হবে। এদিকে সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট অর্থবর্ষে যে ৬০ শতাংশ টাকা প্রথম ভাগে খরচ করার কথা ছিল সেই টাকা জোগাড় করে উঠতেই পারেনি কলকাতা পুরনিগমের অর্থ বিভাগ। ফলে খরচ করার তো দূর, প্রকল্পগুলিও মাঝপথে আটকে থাকল। স্বাভাবিকভাবেই এই কারণে বাকি থাকা ৪০ শতাংশ টাকার উপর থেকে এমবার্গো তোলা হয়নি। এদিকে চলতি ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে রাজস্ব আদায়ে ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৩৩ কোটি ১১ লক্ষ টাকা। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪১০ কোটি ১১ লক্ষ টাকা। বাজেট ঘাটতি ১৭৭ কোটি টাকা। এদিকে বিরোধীদের দাবি, বাজেটের ঘাটতি কমিয়ে দেখানোর জন্যই প্রস্তাবিত প্রকল্প গুলি বাস্তবায়ন করার বদলে টাকা আটকে রাখার উপরে জোর দিয়েছে অর্থ বিভাগ। যদিও একাংশের মতে, টাকা থাকলে তো খরচ হবে। যেখানে প্রথমভাগে হাতে রাখা ৬০ শতাংশ টাকাই সম্পূর্ণভাবে বন্টন করে উঠতে পারল না, সেখানে টাকা আটকে রাখার প্রশ্নই উঠছে না।

মাঝে পুরসভার বেতন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবে পুরসভার তথ্য বলছে, পুরসভার স্থায়ী, অস্থায়ী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের বেতন ও পেনশন দিতে মাসে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা খরচ হয়। এদিকে রোপা ২০১৯ চালু হওয়ায় কর্মী ও অবসরপ্রাপ্তদের বেতন, পেনশন বেড়েছে। তার পরেই করোনা শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি সঙ্গিন হয়ে পড়ে। তাই আদায় বাড়লেও দেনা বেশি থেকে যাচ্ছে।  প্রায় ১৮ হাজার স্থায়ী কর্মীর জন্য মাসে ৭৮ কোটি এবং ২০ হাজার অস্থায়ী কর্মীর বেতন বাবদ খরচ হয় ১৫ কোটি টাকা। ৩৫ হাজার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর জন্য মাসে খরচ হয় ৪০ কোটি টাকা। স্থায়ী কর্মীদের মোট বেতনের ৮৫ শতাংশ রাজ্য সরকার বহন করে। বাকি ১৫ শতাংশ পুরসভাকে বহন করতে হয়। আবার অবসরপ্রাপ্তদের পেনশনের ৬০ শতাংশ পুরসভা দেয়। কিন্তু অস্থায়ী কর্মীদের বেতনের পুরো অর্থই পুরসভাকে বহন করতে হয়।

এদিকে কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদের দাবি, কলকাতা পুরসভার রাজস্বের হাল এখন অনেকটাই ভাল। সম্পত্তি কর বকেয়া যা ছিল, আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এদিকে কলকাতা পুরনিগমের অর্থ বিভাগ সূত্রে খবর, অর্থ সংকটে এতটাই জর্জরিত যে, বাধ্য হয়ে রাজ্য সরকারের যে অনুষ্ঠানগুলি কলকাতা পুরসভা নিজস্ব খরচে করে সেই টাকা চেয়ে কলকাতা পুরসভাকে রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি দিতে হয়েছে। যেমন, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশপ্রিয় পার্কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হয়। সেখানে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা কলকাতা পুরসভা খরচ করে। সেই টাকা চেয়ে কলকাতা পুরসভার তরফে রাজ্য প্রশাসনের কাছে চিঠি গিয়েছে বলে সূত্রের খবর। আর এই ঘটনা থেকে এটাও স্পষ্ট যে, যদি টানাটানি না থাকত, তাহলে কলকাতা পুরসভা কখনওই টাকা চেয়ে চিঠি দিত না। অর্থ সংকটের কথা কলকাতার মেয়র অস্বীকার করলেও ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ অবশ্য জানান, যে টাকা আদায় হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। তাই সংকট কাটতে সময় তো লাগবেই।

পুর অর্থ বিভাগ সূত্রের খবর, শুধু ঠিকাদারদের পাওনাই রয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। তাও এখন তাঁদের ২০২১ সালের মার্চের বকেয়া মেটানো হচ্ছে। ওই মাসেরই বকেয়া ছিল প্রায় ৩২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে এখনও প্রায় ১২০ কোটি শোধ করা বাকি। চলতি আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরসভার বিভিন্ন বিভাগে কর আদায় হয়েছে ১৪১৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে সম্পত্তিকর ৮৮০ কোটি। ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে সব মিলিয়ে আদায় হয়েছিল ১৩৪১ কোটি টাকা। গত আট বছরে সব থেকে বেশি কর আদায় হয় ২০১৭-’১৮ সালে। যার পরিমাণ ১৪১৬ কোটি টাকা। সূত্রে খবর, তার থেকেও চলতি আর্থিক বছরে কর আদায় বেড়েছে।

এদিকে পুরসভার এই অর্থ সংকট থেকে মুক্তি পেতে বারবার রাজস্ব এবং অন্যান্য বিভাগের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে পুরসভার কমিশনার বিনোদ কুমারকেও। এই বৈঠকের পরই জানুয়ারি মাসে তাঁর দেওয়া নির্দেশের ভিত্তিতে জানুয়ারি মাস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য আধিকারিকরা সচেষ্ট হন। ইনস্পেক্টরদের অফিসে বসে না থেকে ওয়ার্ডে ঘুরে কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি। কলকাতা পুরসভার অর্থ বিভাগের কর্তাদের কথায়, সম্পত্তিকর এবং অন্যান্য যে রাজস্ব আদায়ের মূল বিভাগগুলি রয়েছে, সেগুলির প্রথম দিন থেকে যদি সচেষ্ট হত সঠিকভাবে অর্থ আদায় করার ব্যাপারে তাহলে এই সমস্যা হত না। কোষাগারের অবস্থা ভয়াবহ। আদায় বাড়লেও দেনা বেশি থেকে যাচ্ছে। বকেয়া কী ভাবে পরিশোধ করা হবে, তা নিয়ে ঘোরতর চিন্তা তৈরি হয়েছে। এদিকে পুর অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, ঠিকাদারদের বকেয়ার পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা বেশ কয়েক মাস ধরে গ্র্যাচুইটি ও কমিউটেশন বাবদ প্রাপ্য টাকা পাননি। যা মেটাতে কয়েকশো কোটি টাকা দিতে হবে। সম্পত্তিকর বাবদ যেটুকু রাজস্ব আদায় হচ্ছে তা বকেয়া মেটাতেই চলে যাচ্ছে। যে পরিমাণ দেনা হয়ে রয়েছে, তাতে এই এই পরিমাণ আদায়কৃত রাজস্ব দিয়ে চলবে না। সেক্ষেত্রে যারা কোটি কোটি টাকা কর বাকি রেখে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা চালু করতে হবে বলে মনে করছেন পুরসভার শীর্ষ কর্তাদের একাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 − one =