ভোট মাঠে দিলীপকে বোল্ড ‘বহিরাগত’ কীর্তি আজাদের

নিজস্ব প্রতিবেদন, পূর্ব বর্ধমান: ভোটের মাঠে খেলতে নেমে দুঁদে রাজনৈতিক খেলোয়াড় দিলীপ ঘোষকে ক্লিন বোল্ড করে দিলেন তৃণমূলের ‘বহিরাগত’ কীর্তি আজাদ। বাংলায় এসে প্রথমবার নতুন পিচে নেমে রীতিমতো চার ছয় মেরে দিলীপ ঘোষকে উড়িয়ে দিলেন তৃণমূল প্রার্থী কীর্তি আজাদ। মঙ্গলবার সকাল থেকে ভোট গণনার শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনা ছিল পূর্ব বর্ধমান জেলার গণনাকেন্দ্রের সামনে। গণনার শুরুতে বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ এগিয়ে থাকলেও তার কয়েক ঘণ্টা পরেই বদলে যায় চিত্র। পরে কীর্তি আজাদ এগিয়ে গেলেও তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেননি বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ।
নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ার পরে শেষ মুহূর্তে কেন্দ্র বদল করে বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী করা হয় দিলীপ ঘোষকে। প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই একাধিকবার বেলাগাম ও অশালীন মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ান দিলীপ ঘো¡। বারবার দল থেকে তাঁকে সাবধান করা হলেও দিলীপ ঘোষ ছিলেন নিজের মেজাজেই। তবেবিরোধী দলগুলিও সংগঠক হিসেবে দিলীপ ঘোষের প্রশংসা করেছেন বহুবার। আর সেই দিলীপ ঘোষের অস্তিত্ব বর্তমানে সংকটের মুখে। রাজনৈতিক মহলের মতামত, দিলীপ ঘোষকে নিজের দল বিজেপি-ই কোণঠাসা করতে করতে কার্যত খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল তাঁকে। মঙ্গলবার ভোটগণনার পর দেখা যায়, কীর্তি আজাদের কাছে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫৬৪ ভোটে হেরে গিয়েছেন তিনি। গত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে ৩ থেকে ৭৭ আসনের বিজেপির সংখ্যা আসলেও আচমকা রাজ্য বিজেপির পদ থেকে তা¥কে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার বদলে তাঁকে বিজেপি কেন্দ্রীয় সংগঠনের নামে নামমাত্র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করে রাখে। রাজ্য বিজেপিতে দিলীপ ঘোষের বিরোধী গোষ্ঠীর চাপে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন বলে জল্পনা শুরু হয়। সেই সময় দলের সিদ্ধান্ত মেনে দিলীপ ঘোষ কার্যত নীরব থাকেন।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বড়সড় খাঁড়া নেমে আসে দিলীপ ঘোষের ওপর। গত ২০১৯ সালে মেদিনীপুর কেন্দ্র থেকে আশি হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ। সেই কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। দিলীপ ঘোষের জয় করা আসন বিধায়িকা অগ্নিমিত্রা পলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রাতারাতি দিলীপ ঘোষকে তুলে এনে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে প্রার্থী করা হয়। দলের বিরুদ্ধে কোনও রকম ক্ষোভ না জানিয়ে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন তিনি। যে কেন্দ্রটি তাঁর কাছে একেবারে অচেনা সেই কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার পর এই বিষয়ে বারবার বলেছিলেন, যার দম আছে সে যে কোনও কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়ে জিততে পারে। অচেনা জায়গায় নতুন করে নিজের জমি তৈরি করতে বর্ধমান এবং দুর্গাপুর এলাকা রীতিমতো কামড়ে ধরে পড়ে থেকেছেন দিনরাত।
কোথাও প্রাতর্ভ্রমণের ফাঁকে চা চক্রে যোগ দিয়ে বাজারঘাটে মানুষের সঙ্গে কথা বলা, আবার কোথাও তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে মাঠে ব্যাট বল নিয়ে ক্রিকেট খেলতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে। প্রচারের ক্ষেত্রে কোনও রকম খামতি না রাখলেও দিলীপ ঘোষকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের বারবার প্রায় একই জায়গায় ঘোরাতে দেখা গিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে দিলীপ ঘোষের জয় নিয়ে যখন সংশয় দেখা দিতে শুরু করে, তখন তিনি দাবি করেন, কম সময়ে হঠাৎ করে লড়তে হয়েছে, বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে, তার মনে হয় চমক অপেক্ষা করছে।
দিলীপ ঘোষের হারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই পরাজয়ের জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বকেই দায়ী করেছেন দলের একাংশ। যে দিলীপ ঘোষ একহাতে রাজ্যে বিজেপিকে তুলে এনে দাঁড় করিয়েছেন তার প্রতি এমন কাম্য নয় বলে মনে করেছেন অনেকেই। দিলীপ ঘোষের সম্পর্কে জানা যায,û আটের দশকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে তাঁর সংঘের কার্যকর্তা হিসাবে। ২০১৪ সালে প্রথমবার সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেন দিলীপ ঘোষ। আরএসএসসের থেকে তুলে এনে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে নামায় বিজেপি। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সম্পাদক নিয়োগ করা হয় তাঁকে। পরে ২০১৫ সালে রাজ্য বিজেপির সভাপতি নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে ভর করে রাজ্যে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বিজেপি। কিন্তু যে ভাবে ক্রমশ কোণঠাসা করা হচ্ছিল দিলীপকে, তা বিজেপির অ¨রেই অনেকে ভালো ভাবে গ্রহণ করেননি। যার ফলস্বরূপ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ী সিটে প্রার্থী হয়েও তাঁকে হারতে হল।
মঙ্গলবার জয়ের পর সংবাদ মাধ্যমের কাছে তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী কীর্তি আজাদ দাবি করেন, খেলাধুলোর বিষয়ে যেখানে উন্নয়ন করার প্রয়োজন সেখানে তিনি উন্নয়ন করবেন। বিশ্বকাপ জেতার সময় খেলার মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিয়েছিলেন তিনি। এবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে একটা বড় দায়িত্ব দিয়েছে। সেটি হল তাঁর লোকসভা কেন্দ্রে উন্নয়নের কাজ করে মানুষের মন জয় করা। এই দায়িত্ব তিনি পালন করবেন। এদিন জয়ের পর বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের সমস্ত মানুষদের তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। অন্যদিকে, বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রটি ফের তৃণমূলের দখলে ফিরে এল। বিজেপির তারকা প্রার্থী দিলীপ ঘোষকে শেষ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৯৯৯ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বিজয়ী হলেন বিশ্বকাপ জয়ী তৃণমূলের ক্রিকেটার প্রার্থী কীর্তি আজাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 3 =