নিউইয়র্ক কসমস ও সান্তোসের খেলা দিয়ে পেলে ফুটবলকে বিদায় বলার পরদিন ব্রাজিলের একটি পত্রিকা শিরোনামে লিখেছিল, ‘আজ এমনকি আকাশটাও কাঁদছে’। সেই কান্নার মুহূর্তই যেন গতকাল ডিসেম্বরের শীত শীত রাতে আরেকবার ফিরে এসেছিল। শেষ রাতের আকাশটাও কি আরেকটু ভারী হয়ে ছিল না! সেই আকাশেই যে আজ রাতে চিরন্তন হয়ে গেছে একটি নাম—এডসন অরান্তেস দো নাসিমান্তো সংক্ষেপে পেলে।
বিশাল আকাশ, কিন্তু তার চেয়ে বিশালত্ব নিয়ে যে মানুষ পৃথিবীকে পা দিয়ে শাসন করে গেছেন, তাঁর ভার সামলানোর সামর্থ্য সেই আকাশের আছে কি? কে জানে, পৃথিবীর উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে ধারণ করার শক্তি দূর আকাশের আছে কি না! আকাশের হিসাব যদিও আমাদের অজানা, তবে মর্ত্যেরটা আমরা জানিই। যে কিনা সবচেয়ে দামি কোহিনূরটিকে আজ হারিয়ে ফেলল, আর কখনো ফিরবে না তা।
পৃথিবীর বুকে এত এত দেশ! কে কাকে এত মনে রাখে! কার এত দায়! তবুও মানুষ যে কটি দেশের কথা বুঝতে শেখার পর থেকে সবচেয়ে বেশি শোনে, তার একটি ব্রাজিল। কারণ, আর কিছু নয়—ফুটবল। মানুষের অস্ত্বিত্বের সঙ্গে মিশে যাওয়া একটি নাম। বলে লাথি মেরে শৈশব শুরু করেনি এমন মানুষ–ই বা কজন আছে! আর এসবের ভেতর মিশে আছে একটি নাম—পেলে। যে মানুষ কখনো পেলের খেলা দেখেনি, তাঁর কাছেও এই নাম গভীর আবেগের।
একটি বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন পেলে, যাকে বলা হয় ‘মারাকানাজো’ বা মারাকানা বিপর্যয়। ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হারের পর ব্রাজিলের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল এই শব্দবন্ধ। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে যা কিনা হিরোশিমা ও নাগাসাকির মতোই ভয়ংকর। সেই বিপর্যয় জন্ম দিয়েছিল একজন পেলেকে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে যিনি অভিষেকে গোল করবেন। আর সেই কৈশোর পেরোনোর আগেই হয়ে যাবেন ফুটবলের মহানায়ক, বিক্রয়–অযোগ্য জাতীয় সম্পদ। আর ’৭০ বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে সর্বকালের অবিসংবাদিত সেরা। ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামের আরেক জাদুকরের উত্থানের আগপর্যন্ত তিনি থেকে যাবেন একক সত্তা হয়ে। ১৮৮৮ সালে ব্রাজিলে দাসপ্রথার অবসান হয়েছিল, পেলে ছিলেন শিকল থেকে মুক্ত হওয়া কালোদের তৃতীয় প্রজন্ম। আর সেই পেলেই একসময় হয়ে গেলেন ব্রাজিলিয়ানদের তথা ফুটবল রোমান্টিকদের উৎসব ও আনন্দের সমার্থক। তাঁর পায়ে বল মানেই যেন বিথোভেনের সিম্ফনি কিংবা ভ্যান গঘের তুলির আঁচড়। ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে তাঁর দেওয়া পাসটিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা তুলনা করেছিলেন ‘কবিদের কবি’খ্যাত র্যানবোর কাব্যকীর্তির সঙ্গে। অনেকের কাছে তিনিই ফুটবলের শেষ কথা। ফুটবলে গ্রেট হয়তো অনেকেই আছেন। সর্বকালের সেরার অমিমাংসিত লড়াইয়েও পেলেকে হয়তো লড়তে হবে মেসি-মারাদোনার সঙ্গে। কিন্তু একটি আসন এই কালো মানিকের কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না—ফুটবলের রাজার আসনটি, যে আসনের একক মালিকানা সব সময় তাঁরই থেকে যাবে।
পেলের মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে নেইমার লিখেছেন, ‘তাঁর আগে ফুটবল ছিল শুধুই একটি খেলা’। কালো মানিককে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে গিয়ে একটুও ভুল বলেননি হালের ব্রাজিলিয়ান সেনসেশন। পেলে তখন রাজা হয়েছিলেন, যখন খেলাটির ওপর পুঁজির থাবা পড়েনি। বিজ্ঞাপন ও করপোরেটের কলে তখন তারকা বানানো শুরু হয়নি। পায়ের জাদু আর মানুষের ভালোবাসাতেই পেলে তাঁর রাজত্ব দখল করেন।
তবে এটাও সত্যি যে পেলের জনপ্রিয়তা ও শৈল্পিক দক্ষতা পুঁজির কাজটাকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছিল। একপর্যায়ে পেলেই হয়েছেন ফুটবলের সবচেয়ে বড় ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। শুধু কি ফুটবলের? ১৯৭০–এর দশকে এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, ইউরোপে কোকাকোলার পর সবচেয়ে পরিচিত ব্র্যান্ডটির নাম ছিল পেলে। মারাদোনার সঙ্গে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটাও ছিল দেখার মতো। পৃথিবীর শেষ পর্যন্তও হয়তো সেই দ্বৈরথ থেকে যাবে অম্লান। ম্যারাডোনা যেখানে ছিলেন উন্মাতাল রক অ্যান্ড রোলের অন্য নাম, পেলে সেখানে ছিলেন রবিশংকর-বিলায়াৎ খাঁর শান্ত সুর।
পেলে নামটি এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে সেটি থামিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধের দামামাও। নিজের এই পাহাড়ের মতো দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আমৃত্যু ধরে রেখেছেন ফুটবলের এই রাজা। ৮২ বছরের এই যাত্রাপথটা খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে তৈরি করেছিলেন পেলে। কৈশোরে একবার সিগারেট হাতে ধরে ফেলেছিলেন বাবা। বলেছিলেন, ‘পেশাদার ফুটবলার হতে চাইলে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে৷ আর যদি খেতেই চাও, এই নাও টাকা। আমি চাই না, তামাকের জন্য এদিক–সেদিক হাত পাতো।’ এরপর পেলে আর কখনো সিগারেট ছুঁয়েও দেখেননি। এই ঘটনা জানতে পেরে আরেক কিংবদন্তি ফুটবলার জর্জ বেস্ট বলেছিলেন, ‘তুমি হে কেমন রাজা, যে কিনা সিগারেট খাও না, মদও খাও না!’
হ্যাঁ, পেলে ছিলেন এমনই এক রাজা। এমন রাজা হতেও যে চাই কঠোর সাধনা। যে পথ থেকে মৃত্যুর আগমুহূর্তেও বিচ্যুত হননি। ফুটবলের রাজা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন রাজা থেকেই, যাঁর পায়ের স্পর্শ না পেয়ে মর্ত্যের বুক আজ হারিয়ে ফেলেছে তার গরিমা। আর তার আগমনে আজ আরেকটু রঙিন হবে অনন্তলোক।