ভারতের প্রথম মহিলা প্র্যাকটিসিং চিকিৎসক কাদম্বিনীর বাড়ি ভেঙে হবে বহুতল

কলকাতা: ইতিহাস বলে তিনি ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। তিনি এ দেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা প্র‌্যাকটিসিং চিকিৎসক। তাঁর নামে এদেশের অনেকে জানলেও, জানেন না অনেকেই। তাঁকে নিয়ে সম্প্রতি বাংলার দুটি চ্যানেলে টেলি সিরিয়াল হয়েছে।

সেই মহীয়সী মহিলা কাদম্বিনী বসুর বাড়ি আজ জরাজীর্ণ। কালের হিসেবে বট, অশ্বত্থ শিকড় বিস্তার করেছে সেই বাড়িত। কলকাতায় কাদম্বিনী যে বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন, সেই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেখানে তৈরি হবে বহুতল। ‘‌ফার্স্ট গ্র্যাজুয়েট ইন ইন্ডিয়ান ওম্যান’,‌ লিখে গুগলে সার্চ করলেই দেখাবে তাঁর নাম। ‘‌ফার্স্ট ওম্যান ডক্টর ইন ইন্ডিয়া’‌ লিখলেও দেখা যাবে তাঁর ছবি। যে সময়ে মেয়েদের পড়াশোনার কথা কেউ ভাবতেও পারত না, সেই সময়ে তিনি চিকিত্সক হয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেছেন। রাতবিরেতে ফিটনে চড়ে রোগী দেখতে গিয়েছেন। তিনি কাদম্বিনী বসু। বিয়ের পর গাঙ্গুলি। (kadambini ganguly) কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী। দেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা প্র‌্যাকটিসিং চিকিৎসক। প্রতিবছর জন্মদিনে গুগলও এই বাঙালি নারীকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁদের ডুডল পাল্টে দেয়। কিন্তু দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসকের বাড়িটি আজ শুধু অবহেলিত নয়, তার অস্বিস্তও বিপন্ন।
১৩ এ বিধান সরণি। অতীতের কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। এই ঠিকানাতেই এক সময়ে বসবাস করতেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৬১-১৯২৩)। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। অনেকের মতে সেইসময়ের প্রথম ‘‌লাভ ম্যারেজ’‌। তিনি আর কাদম্বিনী থাকতেন তিনতলায়। কাদম্বিনীরই বয়সি দ্বারকানাথের মেয়ে বিধুমুখীর বিয়ে হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে। তিনিও ওই বাড়িরই দোতলায় থাকতেন। এই বাড়িতেই জন্মেছেন উপেন্দ্রকিশোর ছয় সন্তানের মধ্যে পাঁচজন। সুকুমার রায়ও।

বাড়ির একাংশ ভেঙে আগেই প্লাজা তৈরি হয়েছে। এবার অযত্নে নষ্ট হয়ে যাওয়া মূল বসতবাড়িটিও ভাঙা হচ্ছে। তারপর তৈরি হবে আধুনিক বহুতল। দিন কয়েক আগে সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল, বাড়িতে ঢোকার সব গেট টিন দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। মোতায়েন রয়েছেন বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী। তাঁকে গেট খোলার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘ঢোকার অনুমতি নেই। আমার চাকরি চলে যাবে।’‌

আগাছা আর বড় বড় বট অশ্বত্থ গজিয়েছে চতুর্দিকে। হেরিটেজ কমিশন কোনও উদ্যোগই নেয়নি বলে অভিযোগ এলাকার লোকজনের। তবে একবার বাড়ি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল কমিশন। তখন কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন জানিয়েছিলেন, ওই বাড়ি মেরামত করা হবে। হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, একটি নামী জুয়েলার্স কোম্পানি সেটি কিনে নিয়েছে।এ নিয়ে প্রশ্নের মুখে হেরিটেজ কমিশনের প্রতিনিধির বক্তব্য,  বাড়ি সারাতে ১৫-২০ কোটি টাকা লাগবে। কে দেবে।সরকারের কাছে টাকা নেই। তবে, যেহেতু এটা কাদম্বিনীর বাড়ি, তাঁর একটা স্মারক থাকবে।

কাদম্বিনীর বাড়ির উল্টোদিকে প্রসন্ন বস্ত্রালয়। মালিক আশিস দাস জানান, এই বাড়ি ছিল দুর্গাচরণ লাহার। সেকারণে সেটিকে তাঁরা লাহা বাড়ি হিসেবে চিনতেন। পরে এখানে ক্যালকাটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান হয়। যেখানে পড়তে আসতেন রবীন্দ্রনাথ। কিছুদিন ওই বাড়িতে তাঁর আসা যাওয়া হয়েছে বলেই তাঁরা শুনেছেন।

জানা গেল, স্বাধীনতা পরবর্তী কোনও এক সময়ে শরিকি ভাগভাগিতে বাড়িটি বিভক্ত হয়ে যায় দুই ঠিকানায়—১৩এ এবং ১৩বি। ১৩বি অংশটি নিশ্চিহ্ন হয়ে তৈরি হয়েছে প্লাজা। ২০০৫ সালে ১৩ এ অংশটি হেরিটেজ তকমা পায়। কিন্তু গ্রেড আইআইবি ধারায় চিহ্নিত হওয়ায় আইনের ফাঁক রয়েছে। সেই ফাঁক গলে অবশিষ্ট অংশটিও মুছে যাওয়ার অপেক্ষায়। এলাকার অনেকের অভিযোগ, ২০১৫ সাল থেকেই ভাঙার কাজ চলছে।

মৃত্যুর দিনও সকালেও একটা জটিল অপারেশন করেছিলেন কাদম্বিনী। সেদিনই সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়, মারা যান ডাক্তার আসার আগেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three + six =