রাজীব মুখোপাধ্যায়: দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বেলুড় মঠের ভোগ প্রস্তুতের হেঁসেল যিনি দক্ষতার সঙ্গে সামলে আসছেন, শ্রীরাম মন্দিরের দ্বার উদঘাটন ও প্রাণ প্রতিষ্ঠার পূর্বে সেই ঘনশ্যাম পাণ্ডার আক্ষেপ, ‘যদি অযোধ্যায় আমি ভোগের দায়িত্ব পেতাম তাহলে ঠাকুরের কাজ করে আসতাম।’ যার ব্যবস্থাপনা দেখলে চমকে যান এমবিএ করা তাবড় ম্যানেজমেন্ট কর্তারাও। সালকিয়ার ১০১, ভৈরব ঘটক লেনে টালিতে ছাওয়া ছোট্ট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এভাবেই নিজের মত ব্যক্ত করলেন সত্তর ঊধর্ব ঘনশ্যাম বাবু।
ঈশ্বর খান তাই ভোগ নিবেদন আর প্রসাদ বিতরণে গঙ্গাপাড়ের বিশ্ববিখ্যাত সন্ন্যাসী আখড়ায় কোনও দিন কোনও কার্পণ্য হয় না। এমনই তার মাহাত্ম্য। হাজার থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের হাতেই সব সামলান। প্রায় এক লক্ষ লোকের সমাগমের খিচুড়ি রান্নার প্রস্তুতিও অবলীলায় সামলেছেন। সারা বছর ৬ হাজার লোক হলেও সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চারদিনই ৫০ হাজার লোকের জন্য ৩০ কুইন্টাল করে খিচুড়ি রান্না হয়। কুমারী পুজো থাকে বলে অষ্টমীর দিন প্রায় ৬০ কুইন্টাল খিচুড়ি হয় বেলুড় মঠেই। মঠের মূল হেঁসেলের দায়িত্বে থাকেন ঘনশ্যামবাবু। তিনি চাল, ডাল, সবজি মিলিয়ে এ বছর প্রায় ২৫ হাজার কিলো খিচুড়ি তৈরি করেন। ঠাকুর দর্শন এবং পুষ্পাঞ্জলির পর ওই খিচুড়ি ভোগ বিতরণ করা হয়। সেদ্ধ চাল ছাড়াও থাকে দু’হাজার কেজি গোবিন্দ ভোগ চাল, দু’হাজার কেজি মুগ ডাল, ছ’হাজার কেজি আলু, দু’হাজার কেজি গাজর, দু’হাজার কেজি সবুজ মটর। আর থাকে বিট, বিনস, ফুলকপি, আদা, কাঁচা লঙ্কা, গাওয়া ঘি। কয়েকশো কেজি হলুদ, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা ইত্যাদিও লাগে।
মেনুতে খিচুড়ি ছাড়াও রাখা হয় আলুর দম, চাটনি এবং পায়েস। চার হাজার কেজি বোঁদে এবং ১৭ হাজার পিস গজাও তৈরি করা হয় ভক্তদের দেওয়ার জন্য। ঠাকুরের আশীর্বাদে ঘনশ্যামবাবু দেশ বিদেশের হাজার হাজার ভক্তকে বেলুড় ব্র্যান্ডের খিচুড়ি তৈরি করে খাইয়েছেন। এহেন ঘনশ্যামবাবু বলেন, ‘ আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে কোনো অসুবিধা ছিল না। আমার কাছে সেরকম টিম আছে। দায়িত্ব পেলে নিয়ে যেতাম। আমি দেশের বিভিন্ন মন্দিরে ভোগের আয়োজন করেছি। বৃন্দাবন, লখনউ, রায়পুর সহ কুম্ভমেলাতেও ভোগের দায়িত্ব সামলেছি। ভোগের বিশাল মাহাত্ম্য রয়েছে। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই কাজ করে আসছি।’ সালকিয়ার ঘনশ্যাম পাণ্ডাই বেলুড় ব্র্যান্ডের খিচুড়ি তৈরির মূল হোতা। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি মঠের খিচুড়ি তৈরির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ঘনশ্যাম বাবু বলেন, ‘এই ৩০, ৩১ জানুয়ারি, ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি বেলুড় মঠে ফের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে চলে যেতে হবে।’
তার কথায় ঠাকুর খেতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন খাওয়াতেও। যদিও জীবনের শেষ দিনগুলোয় খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। পেটে খিচুড়ির খিদে, অথচ কিচ্ছু মুখে তুলতে পারছেন না। রোগশয্যায় নিজেই বলেছেন একথা। লক্ষ মুখে খাবার কথা বলে অমৃতলোকে গমন করেছিলেন তিনি। তাই আগামীকাল ২২ জানুয়ারি অযোধ্যার শ্রীরাম মন্দিরে যে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও শ্রদ্ধালুদের সমাগম হবে তাই নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো তফাৎ নেই, এখানে সারাবছর অনুষ্ঠান হয়ে যাচ্ছে, আর ওখানে আরও অনুষ্ঠান হবে।’ এতটাই নিজের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার প্রতি আত্মবিশ্বাসী ঘনশ্যাম পাণ্ডা।