লোকসভায় আসানসোলেও গো-হারা সিপিএম, লালদুর্গ জামুড়িয়ায়ও তলানিতে

নিজস্ব প্রতিবেদন, পশ্চিম বর্ধমান: আগেই হয়ে গিয়েছে পঞ্চায়েত ভোট, পঞ্চায়েত ভোটের নানান সন্ত্রাসের অভিযোগ সত্ত্বেও নিজেদের একটা সম্মানজনক জায়গা ধরে রাখতে পেরেছিল লাল ব্রিগেড। কিন্তু এবারের লোকসভা ভোটে আসানসোল কেন্দ্রে গো হারা হেরে তিন নম্বরে পৌঁছল সিপিএম দল। কেন এমন হল দলের অ¨রেই চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
এবারের আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা, বিজেপির টিকিটে আসানসোল কেন্দ্র থেকে লড়েছেন সুরেন্দ্র সিং আলুওয়ালিয়া ও সিপিএমের হয়ে প্রার্থী ছিলেন জাহানারা খান। আসানসোল কেন্দ্রে জয়লাভ করেছেন তারকা প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রশ্ন একটাই, লালদুর্গ বলে পরিচিত জামুড়িয়ার বেশ কয়েকটি সংসদে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে সিপিএমের ভোট। ৬ মাস আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জামুড়িয়ার দশটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৪টি গ্রাম সংসদে সিপিএম প্রার্থীরা জিতেছিলেন। ২০২৪ সালে দেখা গেল পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএমের জেতা ১৪টি গ্রাম সংসদে বিজেপি জিতেছে। আসানসোল পুরনিগমের ১ থেকে ১২ এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ডটি জামুড়িয়া এক নম্বর বরোর অন্তর্গত।
জামুড়িয়ার কর্পোরেশন এলাকায় তৃণমূল পেয়েছে ৩৭৪১৮ টি ভোট, বিজেপি পেয়েছে ৩৪০৪১, সেখানে সিপিএম পেয়েছে ১১৪৮৬ টি ভোট। এছাড়াও নিজের ভোটদান কেন্দ্রে ও অঞ্চলে তৃতীয় স্থানে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের বাম প্রার্থী জাহানারা খান। নিজের ভোটদান কেন্দ্র কেঁন্দা ২২৫ নম্বর বুথে ভোট পেয়েছেন মাত্র ৪ টি। এই বুথে যথাক্রমে তৃণমূল ও বিজেপি পেয়েছে ২৫০ ও ১৬৮টি ভোট। জাহানারা খান জামুড়িয়া বিধানসভার কেঁন্দা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ইস্ট কেঁন্দা এলাকায় ইসিএল আবাসনে থাকেন। সেই ইস্ট কেঁন্দা হিন্দি প্রাথমিক ßুñলের ২২৫ নম্বর বুথে তিনি ভোট দিয়ে থাকেন। তা ছাড়াও পাশের পড়াশিয়া এলাকায় তিনি একটি বেসরকারি ßুñলে শিক্ষিকাও বটে।
পরিসংখ্যান বলছে, আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে মোট সাতটি বিধানসভা রয়েছে, তার মধ্যে জামুড়িয়া বিধানসভাটি লালদুর্গ বলে পরিচিত ছিল। সেখানে মোট দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ১৩টি ওয়ার্ড রয়েছে। হিজলগড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট ভোটার ১৩,২৭৬ জন, ভোট দিয়েছেন ১০৮৫৪, টিএমসি ৪১৫৪, বিজেপি ৪৫২৩, সিপিএম ১৬২৩ পেয়েছে। ৩৬৯ ভোটে লিড বিজেপির। চিচুড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে টিএমসি পেয়েছে ৪৬২৩ ভোট, বিজেপি ৩৫০৯, সেখানে সিপিএম ১০৭৪ টি ভোট। তৃণমূল ১১১৪ ভোটে অন্যদের থেকে এগিয়ে।
ডোবরানা গ্রাম পঞ্চায়েতে টিএমসি পেয়েছে ২১০৫ ভোট, বিজেপির ঝুলিতে ১৯১১টি ভোট ও সিপিএম পেয়েছে মাত্র ৮৮৮টি ভোট। ১৯৪ ভোটে এগিয়ে টিএমসি। কেঁন্দা গ্রাম পঞ্চায়েতে টিএমসি পেয়েছে ৩০০২, বিজেপি ১৭১০ ও সিপিএম পেয়েছে মাত্র ৪৯০টি ভোট। তৃণমূল এগিয়ে ২৯২ ভোটে। ™ড়াশিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের ঝুলিতে ২১২৭ টি ভোট, বিজেপি ২৫৩৪, সিপিএম পেয়েছে ৫২৯টি ভোট। এখানে ৪০৭ ভোটে এগিয়ে বিজেপি।
বাহাদুরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে টিএমসি ৩১৯৫ বিজেপি ৩২৮৩ ও সিপিএম ১২৮৪। এখানেও ৮৮টি ভোটে এগিয়ে বিজেপি। শ্যামলা গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল পেয়েছে ৭০৮৮, বিজেপি ২৬২৭ ও সিপিএম পেয়েছে ৭৭২ টি ভোট। তৃণমূল অন্যদের থেকে এগিয়ে ৪৪৬১ ভোটে। তপসি গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল পেয়েছে ২৫৫২টি ভোট, বিজেপি১৪৮৮টি ও সিপিএম ৬৪৩ ভোট পেয়েছে এখানে। এখানেও ১০৬৪ ভোটে এগিয়ে তৃণমূল।
মদনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে টিএমসি-৩১৩৮, বিজেপি ২২১০, সিপিএম ৯৯৬ টি ভোট পেয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে ৯২৮ ভোটে। চুরুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে টিএমসি ৩৭১২, বিজেপি ৪০৮২ ও সিপিএম পেয়েছে মাত্র ১৬৬১টি ভোট। এখানে ৩৭০ ভোটে এগিয়ে বিজেপি। এই পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার হল যে পঞ্চায়েত ভোটে যে ভাবে সিপিএম তাদের ভোটব্যাংক ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল হঠাৎ করে এ ভাবে লোকসভা ভোটে তাদের ভোট ব্যাংকে ধস চিন্তার বিষয় বলে রাজনৈতিক মহলের জল্পনা।
লালদুর্গ বলে পরিচিত জামুড়িয়ার যে সমস্ত সংসদগুলিতে এবার বিজেপি তাদের ভোট ব্যাংক বাড়িয়েছে, তাতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিপিএমের ভোট বুমেরাং হয়ে বিজেপিতে পড়েছে। যদিও সিপিএম বা বিজেপি আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে।
দলের এই করুন পরিস্থিতি কেন? জামুড়িয়ার সিপিএম নেতা তাপস কবি জানান, দলের ভেতরে হারের কারণ নিয়ে মূল্যায়ন চলছে। পঞ্চায়েতে নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাস সত্ত্বেও ১৪ টি গ্রাম সংসদ জয়ী হয়েছিল সিপিএম। কিন্তু কী কারণে সেই সমস্ত সংসদে বিজেপি জয়ী হল, সে নিয়ে দলের অ¨রে মূল্যায়ন চলছে। আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী জাহানারা খান জানান, এই নির্বাচনে রাজ্য ও কেন্দ্রের দুর্নীতি, বেকারত্ব সামাজিক অবক্ষয় মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি। লক্ষীর ভান্ডারের মতো রাজ্য সরকারের জনমোহিনী নীতি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। জনগণের এই রায় তাঁরা মাথা পেতে নিয়েছেন। সিপিএম দল রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
চুরুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান প্রদীপ মুখোপাধ্যায় জানান, জামুড়িয়াতে সিপিএম দল বলে কিছু নেই যারা সিপিএম তারাই বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের শতাংশ এই নির্বাচনে বেড়েছে, কিন্তু সিপিএমের ভোট বিজেপিতে চলে যাওয়ায় বিজেপির ভোটের শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 − one =