শুভাশিস বিশ্বাস
‘আ গুজরাত, আমে বনাউ ছে’ অর্থাৎ এ গুজরাত আমিই বানিয়েছি, এমনটাই দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর এখানেই শুরু বিতর্কের। বিরোধীদের দাবি, ব্যবসায় গুজরাতকে এক আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির কর্ম নয়। কারণ, স্বাধীনতার পর গুজরাতের বিকাশের ইতিহাসে দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটা হল জওহরলাল নেহরু নর্মদা প্রকল্পের শিলান্যাস। আর দ্বিতীয়টা হল, ভার্গিজ ক্যুরিয়নের হোয়াইট রেভেলিউশন। নর্মদা নদী প্রকল্প নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে। কারণ, বহু মানুষ তাঁদের ঘর হারিয়েছেন। বহু মানুষকে চলে যেতে হয় অন্যত্র। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওই নর্মদা প্রকল্পের ফলে গুজরাতের বিরাট জমি কৃষিযোগ্য হয়ে ওঠে। জওহরলাল নেহরু এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। আর তা চালু হয় মোদির সময়ে। এমনটা নয় যে উনি এলেন আর সর্দার সরোবর ড্যাম চালু হয়ে গেছে।
এদিকে ১৯৬৪-তে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী উদ্বোধন করেন তাঁদের পশুখাদ্য কারখানার। মিল্ক কো অপারেটিভ গুজরাতের গ্রামের চেহারা পালটে দিল। যে সময়ে দেশের দুধ উৎপাদন কমছে, সেই সময়ে গুজরাতে দুধের উৎপাদন কেবল বাড়ল না, সারা দেশে আমূল পৌঁছে গেল বহু প্রোডাক্ট নিয়ে। তার মধ্যে ছিল ঘি, মাখন, পাস্তুরাইজড মিল্ক, কনডেন্সড মিল্ক -সহ আরও কত কিছু। গ্রামে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন চাহিদাও জন্ম নিল। তবে কংগ্রেসের চিমন ভাই প্যাটেলের সময়েই গুজরাতের শিল্পায়নের শুরু। এই চিমন ভাই প্যাটেল আদানিদের হাতে তুলে দেন মুন্দ্রা পোর্ট। এর মধ্যে কংগ্রেস নেতাদের হাত ধরে ধীরুভাই আম্বানি, ‘আম্বানি সাম্রাজ্য’-এর জন্ম দিতে থাকেন। ফলে বিড়লা, টাটা, ডালমিয়া, গোয়েঙ্কাদের মতো স্বাধীনতার আগে জন্ম নেওয়া শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে বেড়ে উঠতে থাকে আম্বানি, আদানিরাও। এরপরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হন মাধব সিং সোলাঙ্কি। প্রাকৃতিক গ্যাস রিফাইনারি থেকে আরও অনেক শিল্প গড়ে ওঠে এই সময়ে। গুজরাত তখন দেশে অর্থনৈতিকভাবে তিন নম্বরে। এরপর বিজেপির প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন কেশুভাই প্যাটেল।
মোদি তখনও গুজরাতের দ্বিতীয় স্তরের নেতা। কেশুভাই প্যাটেলের সময়েও শিল্প এসেছে, ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে। এরপর ৭ অক্টোবর ২০০১ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গুজরাতের কুর্সিতে বসেন মোদি। এরপরই ২০০২ থেকে গুজরাতের রাজনীতি এক অন্যখাতে বইতে শুরু করে। হিন্দুত্বের রাজনীতির, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির ল্যাবরেটরি হয়ে ওঠে এই গুজরাত। কেবল বিরোধী নয়, দলের মধ্যেও বিরোধীশূন্য করে এক নয়া গুজরাত গড়ে তোলেন মোদি। এদিকে এই মোদির আমলেই শতাব্দীর জঘন্যতম দাঙ্গা এই গুজরাতে হয়েছে।
এদিকে কৃষিক্ষেত্রেও যেন মুখ থুবড়ে পড়ে গুজরাত। ২০০৯-২০১০ পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রের অগ্রগতি বা বৃদ্ধি থাকলেও এরপর চাষযোগ্য জমি পড়ে থাকতে দেখা যায় জল আর বিদ্যুতের অভাবে। সমীক্ষা বলছে যার জেরে ২০১৯ পর্যন্ত ১২-১৩ শতাংশ চাষ কমেছে। কৃষকদের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস নেই। গুজরাতে কার্পাস আর বাদামের চাষ হু হু করে বেড়েছিল। দুটো ক্ষেত্রেই কনট্রাক্ট ফার্মিং চালু হওয়ার ফলে কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এদিকে শিল্পে বিরাট ভর্তুকি চালু করেছিলেন মোদি, যার অনেকটাই বজায় আছে। কিন্তু এর সুফল মেলেনি।
সমীক্ষা বলছে, ৯৩-৯৪ শতাংশ শ্রমিক এখনও ইনফর্মাল সেক্টরেই কাজ করছেন। তাঁদের কাজের যন্ত্রপাতি বা ব্যবস্থাও এখনও প্রাচীন। সেখানেও আধুনিকীকরণ এখনও হয়নি। ৪০-৪৫ শতাংশ মানুষ এখনও কৃষি, পশুপালন, মাছচাষ, দুধ ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। আর এখানেই প্রশ্ন, তাহলে ওই বিরাট সাবসিডি দিয়ে শিল্পপতিদের ডেকে কী লাভ হয়েছে? সরকারি হিসেব বলছে রাজ্যের ৪০ শতাংশ মানুষ মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি লাইনের নীচে, যা দেশের অন্যান্য বহু রাজ্যের থেকে অনেক নীচে। হিউম্যান ইনডেক্স-এ গুজরাত পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক পিছিয়ে। আর কোভিডের সময় দেখা গিয়েছিল গুজরাতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। হাসপাতালে ডাক্তার, ওষুধ, অক্সিজেন নেই-এর পাশে উবে যায় প্রশাসনও। লকডাউন কন্ট্রোল করার মানুষও ছিল না, স্বেচ্ছাসেবীরা হাল ধরেছিলেন। এরপরই বিজয় রুপানিকে সরিয়ে আনা হয় ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে। ওই সময়ে সরকারের অপদার্থতা ঢাকতেই এই পদক্ষেপ। অর্থাৎ, মোদি যাকে গুজরাত মডেল বলে দেখাতে চাইছেন তা আদতে এক অমানবিক জমি দখলের মডেল। সরকারি সম্পত্তি বেচে দেওয়ার মডেল। দু’ তিন জন শিল্পপতিকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মডেল।