হুবহু হলিউডের ‘ফাইনাল ডেস্টিনেশন’- সিনেমার চিত্রনাট্য। সেখানে একটি বাসে জার্নি করা কালীন এক কিশোর সেই বাসটিই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে – এরকম স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোনো কারণ ছাড়াই দুর্ঘটনা ঘটার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই এইরকমই চিন্তা করছিলেন শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রের যাত্রী রায়গঞ্জ শহরের বাসিন্দা শিক্ষিকা শ্রাবণী দে। ঠিক তারপরই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। হাড়হিম করা অভিজ্ঞতা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী শ্রাবণী দে মুখার্জীর।
রায়গঞ্জের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষিকা শ্রাবণী দে (মুখার্জী) ও তার স্বামী পেশায় শিক্ষক গৌতম মুখার্জী চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাচ্ছিলেন। শ্রাবণী দেবী বলেন, শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপে আমরা চেন্নাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেই। এ১ কোচে ( সিট নম্বর ১,২) আমাদের সিট ছিল। অন্য এক যাত্রীর অনুরোধে আমরা সিট চেঞ্জ করে কামরার মাঝামাঝি সিটে চলে আসি। ওডিশার বালেশ্বের থেকে সাড়ে ছটা নাগাদ ট্রেনটা চলা শুরু করে। আমি আমার সিটে (লোয়ার বার্থে) শুয়েছিলাম। জানিনা কেন আমার মনে হচ্ছিল যদি হঠাৎ করে যদি এখন অ্যাক্সিডেন্ট হয়, তাহলে কি হবে? এসি কামরায় তো সব দিক বন্ধ, আমরা বেরবো কিভাবে? চোখ বুজে এমনটা ভাবতে ভাবতেই বিকট আওয়াজ। চোখ খুলে দেখি উপরের সিট থেকে লোকজন ট্রেনের মেঝেতে পড়ছে। গোটা কামরাটা ভীষণ দুলছে। কি বীভৎস অবস্থা! কামরায় যারা ছিল সবাই ছিটকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে। আমার স্বামীর সিট সাইড আপারে ছিল। দেখি, সাইড আপারের সাইডে একটি গার্ড থাকে তাতে ও আটকে আছে। আমি ছেঁচড়ে গিয়ে আমার সিটেই মাথায় আঘাত পাই। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। চারিদিকে হাহাকার অবস্থা। দেখি বাচ্চারা পড়ে যাচ্ছে, সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি দেখি আমার নীচে একটি লোক এসে ধাক্কা খেল। সেই সময় আমি কিছু বলতেই পারছিলাম না। আমি একপ্রকার বোবা হয়ে গেছিলাম এবং দেখি আমাদের কামরাটাতেই একমাত্র লাইট ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন ছুটে আসে উদ্ধারের জন্য। কামরাটি একদিকে কাত হয়ে গেছে। আমরা উঁচু দিকে আটকে ছিলাম। পরে স্থানীয় লোকজনই আমাদের উদ্ধার করে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রচুর লোকজন, প্রচুর পুলিশ চলে এসেছিল। প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গেই তৎপর হয়ে গেছিল। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ পাড়িয়ে পাড়িয়ে অনেকটা যাওয়ার পর রেসকিউ টিম আমাদের উদ্ধার করে ন্যাশনাল হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আমাদের সঙ্গে মালদার একটি পরিবারও আছে। পরে আমরা একটি ছোট গাড়ি করে রাত প্রায় ১ টা নাগাদ ভুবনেশ্বরে পৌঁছই। রায়গঞ্জের পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষক এক বন্ধু খবর পেয়ে ভুবনেশ্বরে থাকা তার এক ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই একটা হোটেলের ব্যবস্থা করে। ওই হোটেলেই বর্তমানে আছি।
শ্রাবণীদেবী আরও বলেন, এ যেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। কি বীভৎস দৃশ্য বলার ভাষা নেই। চারিদিকে শুধু মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। আমার মাথায় আঘাত লেগেছে। হোটেলে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই রাতের দৃশ্য ভেসে উঠছে। আক্ষেপ হচ্ছে, কেন ট্রেন দুর্ঘটনার কথা ভাবতে গেলাম। এখন শুধু ভাবছি, ট্রেনের এত যাত্রী যেন সুস্থভাবে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে। ওই খারাপ চিন্তার মতো আমার এই ভাবনা যেন বাস্তবে মিলে যায় এই প্রার্থনাই করছি।
তার স্বামী গৌতম মুখার্জী জানিয়েছেন, অনেক চেষ্টা করে এদিন রাত ৯ টার বাসে ভাইজ্যাগ যাওয়ার টিকিট পেয়েছি। সেখানে পৌঁছে তারপর গন্তব্যে পৌঁছনো ঠিক করব।