নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঁকুড়া: জেলার ‘কালীক্ষেত্র’ হিসেবে পরিচিত বাঁকুড়ার প্রাচীন পুরশহর সোনামুখী। অন্যতম হট্নগর কালী। সারা বছর এখানে নিত্যপুজো হলেও কার্তিকেয় অমাবস্যায় তিথি মেনে বিশেষ বাৎসরিক পুজো হয়।
সোনামুখীর অন্যান্য প্রাচীন পুজোগুলির মতো হট্নগর কালীকে নিয়েও অনেক লোককথা প্রচলিত আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় লোক কথা হল, সোনামুখীর তারিণী সূত্রধর নামে এক বৃদ্ধা প্রতিদিন জঙ্গল পথ পেরিয়ে পায়ে হেঁটে মাথায় ঝুড়িতে করে বড়জোড়ার নিরশা গ্রামে চিঁড়ে বিক্রি করতে যেতেন। সেই চিঁড়ে বিক্রি করে পাওয়া ধান নিয়ে তিনি আবারও পায়ে হেঁটেই সোনামুখী ফিরে আসতেন। প্রায় দিনই লালপাড় শাড়ি পরা একটি ছোট্ট শ্যামাঙ্গি মেয়ে তাঁর সঙ্গে সোনামুখী আসার জন্য বায়না করত। নিরুপায় তারিণী সূত্রধর তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে সম্মত হলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর ওই ছোট্ট মেয়েটি বলে, সে আর হাঁটতে পারছে না। তাকে কোলে নিতে। কিন্তু মাথায় আর কোলে ধানের ঝুড়ি আর বস্তা থাকায় বৃদ্ধা তার অসহায়তার কথা বললে, শ্যামাঙ্গি একরত্তি মেয়ে তার মাথার ঝুড়িতেই চাপার কথা বলে। নিরুপায় তারিণী সূত্রধর তাই করেন।
পরে তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন, ওই মেয়ে তো নেই। তার বদলে রয়েছে দু’টি পাথর। ভয় পেয়ে তিনি সেই পাথর দু’টিকে তুলসীতলায় রেখে দেন। সেদিন রাত্রেই বৃদ্ধা তারিণী সূত্রধর স্বপ্নাদেশ পান, ‘আমার পুজোর ব্যবস্থা কর। পাড়ার আঁকড় গাছের নীচে আমাকে রেখে আয়। আমি মা কালী, তোর ভার বইতে যাতে কোনও কষ্ট না হয় তাই এই পাথর রূপে এসেছি।’ সেই সময় ছোঁয়াছুঁয়ি আর জাতপাতের ঘটনা এতটাই তীব্র ছিল পুরোহিত পুজো করতে অস্বীকার করেন। পরে তিনিও স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো করতে রাজি হন। স্বপ্নাদেশে স্থানীয় জমিদার গিন্নি কাদম্বরী দেবী মন্দির নির্মাণের জন্য একখণ্ড জমি ও পুজো পরিচালনার জন্য কিছু জমি দেন। তখন থেকেই এই পুজো এলাকার মানুষ পরিচালনা করছেন।
প্রাচীন সেই প্রথা মেনে আজও সূত্রধররাই কেবল ঘট আনার অধিকারী। এই ঘট সারা বছর মন্দিরে রেখে পুজো করা হয়। পরের বছর বাৎসরিক পুজোর সময় সেই ঘট বিসর্জন দিয়ে নতুন ঘট আনা হয়। হট্নগর কালীর নামকরণ নিয়ে এলাকায় দ্বিমতও রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ‘হট্ যোগে’ এক যোগী এখানেই সিদ্ধিলাভ করেন। তাই এমন নামকরণ। আবার কেউ কেউ বলেন, মা কালী হঠাৎ নগরে এসেছিলেন। তাই হট্ নগর কালী নামকরণ হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মা কালীর নির্দেশে যে আঁকড় গাছের নীচে পাথর দু’টি রাখা হয়েছিল সেই গাছ আজও আছে। আশ্চর্যের বিষয় সেই গাছে কোনও কাঁটা নেই। এমনকি গাছের আদি মূলের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর পাথর দু’টি আজও সেই আঁকড় গাছের নীচে রেখে পুজার্চনা করা হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় পাথর দু’টি ঋতুভেদে রং পরিবর্তন হয়। পুজো কমিটির সম্পাদক দেবমাল্য হালদার জানান, হট্নগর কালীর পুজো উপলক্ষে এলাকা উৎসবের চেহারা নেয়। হট্নগর কালীকে এখানে গ্রাম্য দেবী হিসেবেই পুজো করা হয়ে থাকে। নানান অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রথা মেনে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার আগের দিন এখানে কয়েক হাজার মানুষকে খিচুড়ি খাওয়ানো হয় বলেও তিনি জানান।