একক ভ্রমণে হালিশহর: ইতিহাস আজও কথা বলে যেথায়

অর্পিতা লাহিড়ী

” দে মা আমায় তবিলদারি, আমি নিমখারাম, নই মা শঙ্করী “

জমিদারি সেরেস্তার খাতায় আপনভোলা মানুষটির সবসময় মুখে মায়ের নাম। এ কী লিখে বসলেন? যখন মানুষটিকে জমিদার বাবুর সামনে হাজির করা হল, অভিজ্ঞ জমিদার বুঝলেন সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির তবিলদারি অন্য জায়গায়, তাঁকে সসন্মানে মুক্তি দিলেন। মা জগদীশ্বরী মেয়ের রূপ ধরে তাঁর বাড়ির বেড়া বেঁধে দিয়েছেন। আজ আমার গন্তব্য সাধক রামপ্রসাদের জন্মভিটা হালিসহর। শুধুই রামপ্রসাদ নন চৈতন্য মহাপ্রভু , নিগমানন্দ সরস্বতী, ঈশ্বরপুরীর রানি রাসমনি,পদধূলি তে ধন্য এই হালিশহরের মাটি।

শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল ৮.৫০ এর শান্তিপুর লোকালে চেপে বসলাম। একদিনের একক ভ্রমণ। একঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগল হালিশহর পৌঁছতে। ওভারব্রিজ টপকে এপারে এলে পাওয়া যায় টোটো। দরদাম করে ঠিক হল সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরিয়ে আবারও স্টেশনে নামিয়ে দেবেন ২০০ টাকা নেবেন।

সদালাপী টোটো চালক দাদা সঞ্জীব সাহা নিজেই গাইডের ভূমিকা নিয়ে নিলেন। জানতে পারলাম।

হালিশহর গঙ্গাতীরবর্তী প্রাচীন জনপদ। অতীতে তার নাম ছিল কুমারহট্ট । একসময় এখানে কুম্ভকারদের অর্থাৎ কুমারদের বা কুমোরদের বিরাট হাট বসত, গঙ্গার ঘাট থেকে হাঁড়ি-কলসী নৌকায় করে চালান হত। তাই ‘কুমারহাট’ বা ‘কুমারহট্ট’ নাম হয়েছিল।সঞ্জীবদার কথা মত প্রথমেই স্বামী নিগমানন্দের আশ্রমে গিয়ে ৫০ টাকার কুপন কেটে নিলাম। ভোগ বিতরণ হবে বেলা ১২ টা ৪০ মিনিট থেকে।

স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী আশ্রম:শ্বেত পাথরের সুবিশাল আশ্রম প্রাঙ্গণ প্রথমেই নজর কাড়ে।

স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসের জন্ম ১৮ আগস্ট, ১৮৮০, মহাপ্রয়াণ ২৯ নভেম্বর, ১৯৩৫। সাধক বামাখ্যাপা ছিলেন নিগমানন্দের তন্ত্র গুরু।সংসারপূর্ব জীবনে তাঁর আসল নাম নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সন্ন্যাসোত্তর তিনি স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংস নামে পরিচিত হন। নলিনীকান্ত ছিলেন সম্পর্কে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র।

বাংলার ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ১৩ অগ্রহায়ণ ইংরেজি ২৯ নভেম্বর, ১৯৩৫ তিনি শরীর ত্যাগ করেন। হালিসহরের এই আশ্রমেই তিনি শায়িত রয়েছেন।রোজ সকাল ৯ টাকা থেকে ভোগ খাওয়ার টিকিট দেওয়া হয়। মূল্য ৫০ টাকা।

রানি রাসমনির জন্মভিটা:হালিশহর ভ্রমণে সঞ্জীব দার গাইড মোতাবেক এবার আমার গন্তব্য রানি রাসমনির জন্মভিটা। হালিসহরের বাগমোড় থেকে টোটো নিয়ে এগিয়ে চলা। ভাগীরথীর তীরে মুখোপাধ্যায় পাড়ায় জন্ম নেন এই মহীয়সী নারী। অকাল প্রয়াত স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের জমিদারি কে সঠিক পথে পরিচালনা। কাশী যাত্রা স্থগিত করে ফিরে আসা। মা ভবতারিণীর মন্দির স্থাপনা। গদাধর থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। বাকিটা ইতিহাস।

দক্ষিণেশ্বের ভবতারিণী মন্দিরের আদলে তৈরি মন্দির। মন্দিরের উপর তলায় মা ভবতারিণীর মূর্তির অনুরূপ বিগ্রহ। নিচে ছবি, দিব্যত্রয় এবং রানির ছবি।

পাশেই রয়েছে গঙ্গা জনপ্রতি ৫০ টাকা ইচ্ছে হলে ভেসে পড়ুন নৌকায়। একঘন্টার জন্য এক অনাস্বাদিত ভ্রমণের আস্বাদ নিন।

চৈতন্য ডোবা:হালিসহরের এই চৈতন্য ডোবা বৈষ্ণবদের জন্য এক পরম তীর্থস্থান।কথিত আছে চৈতন্য মহাপ্রভুর দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী মহারাজে জন্মস্থানও এই পূণ্যভূমি। এখানে ভূমি স্পর্শ করার পর এক মুঠো মাটি তুলে নেন মহাপ্রভু। তাঁর দে অন্যরা। এর ফলে তৈরি হয় এক জলাশয়। যা আজ চৈতন্য ডোবা বলে খ্যাত। ভেতরে আছে শ্যামসুন্দর জির যুগল মূর্তি। ডোবটিরও সৌন্দর্যয়নের কাজ চলছে। এখানেও নটার মধ্যে এলে ভোগ খাওয়ার টিকিট পাবেন।

রামপ্রসাদের জন্মভিটা:ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে এবার সাধক কবির ভিটায় পা রাখলাম। বারোটা বেজে গিয়েছে দর্শন বন্ধ। তাই পাশের জানালা দিয়ে দর্শন হলো। প্রণাম করলাম পঞ্চবটির আসনে। সাধক কবির সাধন ভূমি।

পাশেই রয়েছে ঘাট, বয়ে চলে ভাগীরথী। এখানেই নিজের আরাধ্যা জগদীশ্বরি কে রামপ্রসাদ ভাগীরথীতে আত্মবিসর্জন করেন। টোটো চালক দাদা বলে চলেন বহু খুঁজেও নাকি রামপ্রসাদের পার্থিব দেহ মেলেনি।
এবার নিগমানন্দের আশ্রমে প্রসাদ খেয়ে ফেরার পালা।

তাও অদেখা রয়েগেল অনেক কিছু। মা টানলে আবারও আসবো। শিয়ালদহমুখি লোকাল তখন তীব্র স্বরে যাত্রীদের জানান দিচ্ছে।

কী করে যাবেন: শিয়ালদহ থেকে যেকোন মেন লাইনের লোকালে হালিসহর স্টেশন। ভাড়া ১০ টাকা।

কী দেখবেন:উপরে উল্লিখিত স্থান গুলো ছাড়াও হালিসহর মিউনিসিপালিটি পার্ক আছে।

কোথায় থাকবেন: এটা মূলত ডে ট্রিপ, থাকতে চাইলে হালিশহর মিউনিসিপালিটির গেস্টহাউস আছে।

কী খাবেন: নিগমানন্দের আশ্রম, রাসমণির জন্মভিটা, রামপ্রসাদের জন্মভিটা, চৈতন্য ডোবা এই সবকটিতেই ভোগ খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। সকাল ৯ টায় টিকিট দেওয়া শুরু হয়।

টোটো কাম গাইড দাদা সঞ্জীব সাহা: +918820460851

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen + fifteen =