মহেশ্বর চক্রবর্তী, হুগলি
হুগলির আরামবাগের গড়বাড়ির রাজবাড়ি। অন্তত ছ’শো বছরের পুরনো এই বাড়ির দুর্গাপুজো ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। শরৎকালে নিয়ম মেনে রাজবাড়িতে যেমন মা দুর্গার আরাধনা হয়, তেমনই চৈত্র মাসে পুজো হয় দিঘির মন্দিরে। শোনা যায়, একবার এক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। দিঘির জল থেকে দেখা গিয়েছে নতুন শাঁখা পরা দশ হাত। তারপরেই চৈত্রে আরও একবার পুজোর সূচনা।
আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় নানা ঘটনা। লোকমুখে এখনও ছড়িয়ে পড়ে নানা অলৌকিক কর্মকাণ্ডের কথা। গড়বাড়ির রায়েদের এই ঐতিহ্যময় পুজোর কথা রামকৃষ্ণ কথামৃততে উল্লেখ আছে বলে দাবি রাজপরিবারের সদস্যদের।
এ পুজোর শুরু সঙ্গে জড়িয়ে স্বপ্নাদেশ। জানা গিয়েছে, রাজপুতনা থেকে এক সিদ্ধ পুরুষ রনজিৎ সিংহ তৎকালীন আরবানগরীর গড়বাড়ি নামে এক জনপদে আসেন। বর্তমানে এটি আরামবাগ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। তখন চারদিকে ঘন জঙ্গল। বন জঙ্গল পরিষ্কার করে জমিদারির পত্তন হয়। রনজিৎ সিংহকে সে সময় সকলেই রাজা বলে জানত ও মানত। পরবর্তী ক্ষেত্রে রায় নারায়ণ উপাধি পেয়ে তিনি হলেন রনজিৎ রায়। তিনি একাধারে একজন রাজা হলেও সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন।
জনশ্রুতি, রাজার কোনও সন্তান ছিল না। একদিন রাজার সাধনায় তুষ্ট হয়ে মা দুর্গা স্বয়ং শিশু কন্যা রূপে তাঁর বাড়তি এসেছিলেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঘন জঙ্গল থেকে শিশু কন্যা রুপী মা দুর্গাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন রাজা রনজিৎ রায়। দেবী দুর্গা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, যতদিন না তুই নিজে চলে যেতে বলবি ততদিন তোর ঘরে মেয়ে হয়ে থাকব। চলে যেতে বললে আর কখনও ফিরে আসবো না। মেয়েকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর রাজা রনজিৎ রায়ের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে কাটছিলো। একদিন রাজা তাঁর রাজকার্য নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। মেয়ে খুব বিরক্ত করছিলো। রাজার মনঃসংযোগ ক্ষুন হচ্ছিলো বলে তিনি নিজেও বিরক্ত হলেন। সেই সময় মেয়ে রূপী মা দুর্গা রনজিৎ রায়কে জানান,আমার কথা না শুনলে আমি চলে যাবো। বারবার মেয়ে রাজাকে এই কথা বলায়, রাজা রণজিৎ রায় কিছু না ভেবেই বলেন, ‘যা তোর যেখানে খুশি।’ তারপর অনেকক্ষন মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অবশেষে একজন শাঁখাড়ি এসে রাজাকে বলেন, ‘তোমার মেয়ে আমার কাছে শাঁখা পড়েছে, তার দাম দাও। মেয়ে বলেছে কুলুঙ্গিতে পয়সা রাখা আছে। এরপরই রাজা তার ভুল বুঝতে পেরে শাঁখারির কাছে কোথায় মেয়ে আছে তা জানতে চাইলেন। শাঁখারি তাকে রাজার খনন করা দিঘির পাড়ে নিয়ে যায়। কিন্তু মেয়েকে দেখতে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। যখন বুক চাপড়ে মা দুর্গাকে ডাকতে লাগলেন তখন দিঘির মাঝখান থেকে তুন শাঁখা পড়া দশটি হাত দেখা যায়। কিছু সময় পরই তা মিলিয়ে যায়। এই অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো চৈত্র মাসের আম্রবারনীর দিনে। সেই থেকে চৈত্র মাসেও দুর্গা পুজো হয় দিঘির মন্দিরে এবং দানমেলা বসে। ™াশাপাশি শরৎকালেও রাজবাড়িতে ঐতিহ্য মেনে দুর্গা পুজো হয়।
বর্তমানে রাজার রাজত্ব না থাকলেও প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে পুজো পাঠ হয়। রাজবাড়ীর বংশধরেরা এই সময় মিলিত ভাবে এই দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। রীতি মেনে নৈবেদ্যতে ১৬-১৮ মন আতপ চাল থাকে। ছাগ বলি থেকে শুরু করে প্রাচীন প্রথা প্রচলিত আছে, এমনটাই জানান রনজিৎ রায়ের বংশধর দীপক কুমার রায়।