পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্র অব্যাহত তৃণমূলের জয়ের ধারা

জয়যাত্রা অব্যাহত ঘাসফুলের। গ্রাম পঞ্চায়েতের ফল ঘোষণা শুরু হতেই বিরোধীদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় শাসক দল। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদ , গণনা যত এগিয়েছে ততই হাত শক্ত হয়েছে  তৃণমূলের। পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্রই মোটামুটি এই ট্রেন্ড বজায় রয়েছে। একই সঙ্গে বিজেপির ভোট ব্যাংকে ধ্বসের ইঙ্গিত স্পষ্ট পঞ্চায়েতের জনাদেশে। শুন্য থেকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাম এবং কংগ্রেস। সামান্য জায়গায় হলেও দাগ রেখেছে আইএসএফ।এবারের পঞ্চায়েত ভোটে ১২ বছর বাদে পাহাড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি। নিরঙ্কুশ অনিত থাপার দল। অনীক থাপার সঙ্গে ছিল তৃণমূলের সমর্থন। পহাড়ের এই জয় বুঝিয়ে দেয় পাহাড়ের মানুষ রাজ্যভাগে বিপক্ষে রয়েছে। দার্জিলিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট আসন সংখ্যা ৫৯৮। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা জয়লাভ করেছে ৩৪৯ টি আসনে। অন্যদিকে মিরিক ব্লকের ৫ টি আসনে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যরা জিতেছে। সেখানে বিজেপি ও মহাজোটের আসন সংখ্যা ৫৯ এবং নির্দল প্রার্থী জয়ের সংখ্যা ১৮৫। বিজেপি, মহাজোট ও নির্দল প্রার্থীর সংখ্যা যোগ করলেও শতাধিক আসনে এগিয়ে অনিত থাপারা। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ১৫৬ টি আসনে ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা পেয়েছে ৯৬ টি আসন।

ওদিকে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারেও তৃণমূলের জয়জয়কার। ডুয়ার্সের চা-বাগানে চা বাগানে ধূলিসাৎ বিজেপির গড়। বহুদিন পর লড়াইয়ে জোরদার ঘাসফুল শিবির। জলপাইগুড়ি ২৪টি জেলা পরিষদের আসনের মধ্যে ২৪টিই জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেস।আলিপুরদুয়ারেও জেলা পরিষদ দখলে নিয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতি অবশ্য খানিক দাগ কেটেছে বিজেপি। তবে মোট ফলের নিরিখে নেহাৎই নগণ্য। ১২২টি আসন ইতিমধ্যেই জিতে গিয়েছে তৃণমূল। ওদিকে বিজেপির ঝুলিতে ৪২ আসন। একইসঙ্গে কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর সর্বত্রই বিজেপি ক্ষয়িষ্ণু, বর্ধিষ্ণু তৃণমূল।  ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের বিধানসভা ভিত্তিক ফলের হিসাবে তৃণমূল এগিয়ে ছিল ২৫টি আসনে এবং বিজেপি ১৯টি কেন্দ্রে। লোকসভা ভোটের সময় থেকেই উত্তরবঙ্গে তৃণমূলে ধস নামে। সেখানে বিজেপির জমি শক্ত হয়। যে ধারা অব্যাহত ছিল একুশের বিধানসভা ভোটেও। কিন্তু এবার চাকা ঘুরল।

উল্লেখ্য, মালদায় যদিও বাম-কংগ্রেস খানিকটা লড়াই দিয়েছে তবে উত্থান হয়েছে তৃণমূলেরই। মালদায় পঞ্চায়েত সমিতিতে ২০০ আসন পেতে চলেছে তৃণমূল। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেস। মোট ৭৮ আসন জয়ের পথে। আর বিজেপি ৭১ আসন পেতে চলেছে। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী। এবার পঞ্চায়েত ভোটে অধীর গড় মুর্শিদাবাদেও হতাশাজনক ফলাফল কংগ্রেসের। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের ৭৮টি আসনের মধ্যে ৬৫টি আসন পেতে চলেছে তৃণমূল-ই। কংগ্রেস সেখানে অনেক পিছনে, মাত্র ৫টি জয় পাচ্ছে। পঞ্চায়েত সমিতির আসনের নিরিখে তৃণমূল পাচ্ছে ৪২৬টিরও বেশি আসন। যেখানে কংগ্রেসের ঝুলিতে এখনও পর্যন্ত গিয়েছে মাত্র ১২৫টি আসন। আরও ৩টি জয়ের পথে। সাগরদিঘিতেও তৃণমূল নিরঙ্কুশ। উল্লেখ্য, সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছিলেন বাইরন বিশ্বাস। কিন্তু তিনি আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। আর এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তৃণমূলের পক্ষেই গেল সাগরদিঘির রায়। সাগরদিঘির ১১ গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র একটা বাম-কংগ্রেস জোটের হাতে থাকার সম্ভাবনা।

পাশাপাশি, পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়া গড়ে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপি। ঘাঁটি মজবুত হল তৃণমূলের। গত বিধানসভা ভোটে যখন সারা রাজ্যে বিজেপি পর্যুদস্ত হয়, তখনও মতুয়া গড়ে নিজেদের ভোট ব্যাংক বজায় রাখতে পেরেছিল বিজেপি। কিন্তু এবার পঞ্চায়েত ভোটে ধস নামল বিজেপির। পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়ার ভোট ব্যাংকে ধস স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা বাড়িয়েছে বিজেপি শিবিরের। শুধু নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনা নয়, অন্য এলাকাতেও মতুয়া ভোটব্যাংকে ধস চাপে ফেলেছে গেরুয়া শিবিরকে। প্রসঙ্গত, নবজোয়ার কর্মসূচিতে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে গেলেও বিজেপি সাংসদ-বিধায়ক, কর্মীদের বাধায় মূল মন্দিরে পুজো দিতে পারেননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যার জবাব মতুয়ারা ভোটবাক্সে দেবেন বলে তখনই জানিয়েছিলেন অভিষেক। বাস্তবে ঘটলও তেমন।

ওদিকে জঙ্গলমহলেও পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের জয়জয়কার। জঙ্গলমহলের তপসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য নির্ধারিত কেন্দ্রীয় সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সমানে সমানে লড়েছে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। ছিল কুড়মি সমাজেরও আন্দোলন। এমনকি এবার পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে কোনও ভোট নয় বলেও স্লোগান তোলে কুড়মিরা। এবার পঞ্চায়েত ভোটে কুড়মি ভোট বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে বলে মত ছিল ওয়াকিবহল মহলেরও। কিন্তু সব হিসেব-নিকেশকেই ভুল প্রমাণিত করেই জঙ্গলমহলে হাসল তৃণমূল। এখন পঞ্চায়েত ভোটের এই ফলাফল চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে অনেক সমীকরণ বদলে দিতে পারে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এর পাশাপাশি, ভাঙড় বাদে অন্য সব সংখ্যালঘু গড়েই অটুট তৃণমূলের প্রভাব। উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া গ্রামীণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বসিরহাট প্রভৃতি জায়গায় অটুট সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক। একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু ভাঙড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − 4 =