নিজস্ব প্রতিবেদন, ঝাড়গ্রাম: কেউ বলেন বনদেবী। কারও কাছে বনদুর্গা। এখানে পুজো হয় পাথরে। ব্রাহ্মণ, পুরোহিত নন। শবরদের দুর্গা পুজো পান শবরদের হাতেই। প্রায় সাড়ে চারশো বছরের প্রথা মেনে আজও পুজো হচ্ছে ঝাড়গ্রামের গুপ্তমণি মন্দিরে।
আজ থেকে প্রায় ৪৫০ বছর আগে ঝাড়গ্রামের রাজা রূপনারায়ণ মল্লদেবের রাজত্ব এই সমস্ত এলাকায় বিস্তার করেছিল। তৎকালীন রাজা নিজের রাজ্যকে রক্ষার জন্য রাজপ্রাসাদ থেকে বেশ কিছু গুপ্ত রাস্তা বানিয়ে ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সুখনি বাসের গুপ্ত রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে একদিন রাজার প্রিয় হাতি চলে যায় এবং সুখনিবাসাতে গিয়ে পৌঁছয়। রাজা খবর পেয়ে তৎক্ষণা সৈন্যবাহিনী নিয়ে গিয়ে তাঁর প্রিয় হাতিকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে দেখেন, সেখানে ঘোর অরণ্যের মাঝে লতাপাতা দিয়ে বাঁধা আছে।
রাজা হাতিকে আনার জন্য শত চেষ্টা চালালেও সফল হতে পারেননি। যে হাতি রাজার কথা শুনত, সে চিনছে না, রাজা শেষমেষ রাজপ্রাসাদ ফিরে আসেন সেই রাতে রাজা রূপনারায়ণ মল্লদেব স্বপ্নাদেশ পান। এক দেবী তাঁকে বলেন, ‘তোমার যে গুপ্ত রাস্তা রয়েছে তার পাশেই আমি রয়েছি। এখানে একজন আমাকে দীর্ঘদিন ধরে সেবা করে আসছেন। সুখনি বাসার বাসিন্দা শবর পরিবারের নন্দ ভক্তা তাঁর নাম, তার সঙ্গে তুমি গিয়ে যোগাযোগ কর তোমার হাতি তুমি ফিরে পাবে।
সেই কথামতো তারপরের দিনই রাজা সুখনিবাসা গিয়ে পৌঁছন এবং নন্দ ভক্তাকে সব কথা খুলে বলেন রাজা, নন্দ ভক্তা জঙ্গলে এসে তুলসি, বেলপাতা, জল দিয়ে মায়ের পুজো করেন এবং রাজ রূপনারায়ণ মাল্লদেবকে বলেন রাজা বাহাদুর এখন আপনার হাতিকে আপনি ডাকুন আপনার কথা শুনবে। তারপর রাজা তাঁর প্রিয় হাতিকে রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, তখন থেকে এখানে মায়ের পুজো শুরু হয়েছিল, মা যেহেতু এখানে গুপ্ত জায়গায় রয়েছিলেন তাই মায়ের নাম গুপ্তমণি হিসেবে পরিচিত হল সমস্ত অঞ্চলে।
এখানে কোনও পুরোহিত দিয়ে পুজো হয় না গীতা পাঠ, চণ্ডীপাঠ, যজ্ঞ কিছুই হয় না। তৎকালীন শবর পরিবারের নন্দ ভক্তা যেভাবে পুজো করতেন ঠিক একই রকমভাবে এখনও শবররা পুজো করে আসছেন। দুর্গাপুজোর সময় এখানে ঘট বসিয়ে পূজা হয় এবং যে মূর্তি এখানে আবির্ভাব হয়েছিল, সেই মূর্তিকে পুজো করেন শবররা। কথিত আছে, এই মন্দির আজও সন্ধ্যায় নিমজ্জিত হয় অন্ধকারে, মন্দিরের ভিতরে কোনও দিন আলো জ্বালানো হয় না। এখানে বলি প্রথা রয়েছে, প্রতি সপ্তাহে বুধ ও শনিবার বলি হয়। কারও কোনও কিছু হারিয়ে গেলে হাতি, ঘোড়ার মাটির মূর্তিতে সুতো বেঁধে দিয়ে এখানে মানসিক করলে তা পরে ফিরে পাওয়া যায়।
এই সমস্ত অঞ্চলে কেউ গাড়ি কিনলে মা গুপ্তমণির কাছে প্রথম পুজো দেন, এই মন্দিরের ইতিহাস শুনলে অনেকেই এই মন্দিরের দুর্গাপুজো দেখতে আসার জন্য উৎসাহ প্রকাশ করেন। কলকাতা মুম্বইগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই অবস্থিত মা গুপ্তমণি মন্দির। ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরত্ব এবং খড়গপুর স্টেশন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এই মন্দির।