চলাফেরার ক্ষমতা হারানো হবু ডাক্তারকে নতুন জীবন দিলেন কলকাতার চিকিৎসকরা

অদম্য চেষ্টা, সকলের প্রবল ইচ্ছেশক্তি যে জীবনে ভালো কিছুর সন্ধান দিতে পারে তা আরও একবার প্রমাণ হল। দুর্ঘটনার জেরে হাঁটাচলার ক্ষমতাহীন হয়ে পড়া ডাক্তারির ছাত্র পাঁচ মাস পর আবার নব জীবন পেলেন। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসকরা যেন অসাধ্য সাধন করে নতুন ইতিহাস লিখলেন। ডাক্তারির ছাত্রও নতুন করে পড়াশোনার জগতে ফিরতে পারবেন জেনে খুশির হাওয়া।  শুরু হচ্ছে তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়।
বাড়ির ছোট ছেলেকে আদর করে সবাই ‘নিউটন’ বলে ডাকে। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর নদিয়ার বাড়িতেই গাছ কাটছিলেন তিনি। হঠাৎ কাটা গাছের ডালটা দেবব্রতকে নিয়ে হুড়মুড় করে আছড়ে মাটিতে পড়ে। কাটা ডাল সরিয়ে উঠতে গিয়ে নিউটন বুঝতে পারে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অসাড়। হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এক লহমায় চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল। একতলা বাড়ি সমান গাছ থেকে পড়ার যন্ত্রণার থেকেও অনেক বড় কষ্ট তখন তরুণের। নিজে ডাক্তারির ছাত্র, তাই খানিকটা বুঝতে পেরেছিলেন, কোমরের হাড় তো বটেই নার্ভের বড় ক্ষতি হয়েছে। তাই এমন অবস্থা। পিজি হাসপাতালের ফিজিক্যাল আন্ড স্পোর্টস মেডিসিন বিভাগে বসে নিউটন বলেছেন, কোনওরকমে অসাড় দেহটা কলকাতায় নিয়ে আসেন পরিজনরা। একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে এক্স-রে করে দেখা যায় ডান পায়ের কোমরের হাড় ভেঙেছে। তড়িঘড়ি অপারেশন হল।
কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয় না। শারীরিক যন্ত্রণা তো আছেই তারওপর কার্যত চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে মানসিক যন্ত্রনায় তলিয়ে যেতে থাকেন ডাক্তারির ওই ছাত্র। কলকাতার একটি বিখ্যাত স্নায়ু চিকিৎসার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। মেরুদণ্ডের এমআরআই করে দেখা যায় এল-ওয়ান হাড় ভেঙে সরে গিয়েছে। চিকিৎসকদের কথায়, ‘এই হাড় কোমর থেকে শরীরের নিম্নাঙ্গের স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে। কোনওরকম আঘাতে পক্ষাঘাত হয়।’ ওই হাসপাতালে এল-ওয়ান হাড়ের অস্ত্রোপচার হল। দিনসাতেক হাসপাতালে কাটল। কোমর থেকে নিম্নাঙ্গের অবস্থা আগের মতো। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই।
নিউটনের কথায়, বাড়ির লোকজন যখন গভীর হতাশা বুকে নিয়ে ফেরার উদ্যোগ করছেন হঠাৎ একটা ফোন আসে তাঁর দাদার কাছে, পিজির ফিজিক্যাল অ্যান্ড স্পোর্টস মেডিসিনের রিহ্যাবে একটাই বেড খালি আছে। ১৪ ডিসেম্বর পিজিতে ভর্তি হন নিউটন। বিভাগীয় চিকিৎসকরা আসেন। শুরু হয়  তাঁকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো অদম্য লড়াই। ডাক্তারির ছাত্র হওয়ার সুবাদে তাঁর সঙ্গেই  পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলত।
আর তারপরের একটা বিশেষ দিন যেন অবিকল কোনও সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো। নিউটনের কথায়, ‘একদিন স্যরের ঘাড়ে ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি। হঠাৎ স্যর সরে গেলেন। কোনও রকমে পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম দূরে স্যর হাসছেন।’  নিউটনের কথায় চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল ব্যায়াম। মাঝরাতে অনেকবার নিউটন উঠে বসার চেষ্টা করেও পারেননি। তবে একদিন যখন তাঁর স্যারের কাঁধে ভর করে হাঁটতে গিয়ে অসাধ্য সাধন হল তখন আবার নতুন করে মনের জোর ফিরে পেলেন ওই ডাক্তারির ছাত্র।
এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া বলছেন বিশ্বাস করতেই কেমন লাগছিল। প্রথমে ওয়াকার। পরে এলবো ক্র্যাচ দিয়ে হাঁটলেও এখন স্বাভাবিকভাবেই ওয়ার্ডে হাঁটেন হবু ডাক্তার। তাঁর স্বপ্ন, একজন ডাক্তার হওয়ার। চিকিৎসা  করে এমন অনেককে নতুন জীবন দেওয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − 7 =