খণ্ড-বিখণ্ড দেহ, ইস্পাত কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মৃত্যু সিনিয়র টেকনিশিয়ানের

দুর্গাপুর: দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কারখানার সিনিয়র টেকনিশিয়ান আশুতোষ ঘোষালের (৫৪) দেহ। বৃহস্পতিবার রাতে ওই স্থায়ী কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
আরএমএইচপি (Raw Material Handling Plant) বিভাগের স্থায়ী কর্মী ছিলেন আশুতোষ ঘোষাল। সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, এদিন রাতে কর্মরত অবস্থায় আশুতোষ ঘোষাল হঠাৎই কনভেয়ার বেল্টের ওপর পড়ে যান। কনভেয়ার বেল্টে আটকে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সিনিয়র টেকনিশিয়ান আশুতোষ ঘোষালের দেহ। প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের প্রচেষ্টায় তাঁর দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ইস্পাত কলোনির বঙ্কিমচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা আশুতোষবাবুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া শ্রমিক মহলে। বাড়িতে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। দিন কয়েকের মধ্যেই একমাত্র ছেলের বিয়ে ছিল। শোকে পাথর পরিবার পরিজন। গোটা ঘটনায় কার্যত হতবাক শ্রমিক মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ববৃন্দ।
প্রসঙ্গত, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই নিয়ে গত দিন পনেরোর মধ্যে ৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হল। আর ১ জন এখনও আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চলতি বছরের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি দুর্ঘটনা দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায়।
ইস্পাত কারখানার সিটু নেতা সৌরভ দত্ত এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আশুতোষ ঘোষাল এদিন রাতে কাজ করছিলেন আরএইচএমপির পুরনো সাইটে। প্ল্যান্টের হাই লাইনে রিক্লেমার মেশিনের বেডে দাঁড়িয়ে তিনি কাজ করছিলেন। এই রিক্লেমার মেশিন থেকে লৌহ আকরিক প্রায় ৫-৬ ফুট নীচে কনভেয়ার বেল্টে পড়ে। যিনি রিক্লেমার মেশিন চালাচ্ছেন, তাঁকে মাঝে মধ্যে ঝুঁকে দেখতে হয় যে কনভেয়ার বেল্ট বন্ধ হল কিনা। কিন্তু নিরাপত্তার মাপকাঠিতে নিয়মানুযায়ী রিক্লেমার মেশিন বন্ধ হলে কনভেয়ার বেল্ট বন্ধ হয়ে যাবে। এই ব্যবস্থা রয়েছে আরএইচএমপির নতুন ইউনিটে। কিন্তু পুরনো ইউনিটে সেই ব্যবস্থা নেই। সেক্ষেত্রে মেশিন অপারেটরকেই ঝুঁকে দেখতে হয় যে কনভেয়ার বেল্ট ঠিকমতো চলছে কিনা। কারণ বেল্ট না চললে লৌহ আকরিক কনভেয়ার বেল্টে জমে গিয়ে উৎপাদন ব্যহত হবে। এর অন্যপ্রান্তে রয়েছে লৌহ কাটার।’ সৌরভ বাবুর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘কনভেয়ার বেল্ট চালু রয়েছে কিনা তা দেখতে গিয়ে কোনোভাবে পড়ে যান আশুতোষ বাবু এবং কনভেয়ার বেল্টে এগিয়ে যেতে থাকেন। অপর প্রান্তে যে স্টিল কাটার রয়েছে, সেখানে তাঁর পা ঢুকে যায় এবং দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু ঘটে।’ তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে বারংবার বলা সত্ত্বেও যন্ত্রাংশের আধুনিকীকরণ করা হয়নি। ফলে, ১৯৬০ সাল থেকে এইভাবেই চলছে।’
এদিকে, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় ঘটে যাওয়া একের পর এক দুর্ঘটনার জেরে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে শ্রমিক মহলে। অভিযোগ, নিরাপত্তার গাফিলতির কারণেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, আর মৃত্যু মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। অবিলম্বে কর্তৃপক্ষ যদি নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে পর্যালোচনা না করে, তাহলে আগামী দিনে এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করছে, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সিনিয়র টেকনিশিয়ান আশুতোষ ঘোষালের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিটুর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন। আর দুর্ঘটনার ভয়াবহতায়, শ্রমিকদের আতঙ্ক যেন কিছুতেই কাটছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × one =