সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম তমলুকের বর্গভীমা মন্দির আজও জাগ্রত

সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম পীঠ হল তমলুকের দেবী বর্গভীমার মন্দির। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে খন্ডিত হয়ে সতীর বাম পায়ের গোড়ালি পড়েছিল এই শহরে। আর সেই থেকেই তাম্রলিপ্ত নগরীতে গড়ে উঠেছে দেবী বর্গভীমার মন্দির। যা আজও পূর্ণ মহিমায় জাগ্রত। তমলুকে ধুমধাম করে কালীপুজো হলেও দেবী বর্গভীমা অনুমতি না নিয়ে এখনো কোনো পুজো শুরু হয় না।

দেবীর ৫১টি সতীপীঠের অন্যতম পীঠ হল তমলুকের বর্গভীমা মন্দির। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় কয়েক হাজার প্রাচীন মন্দির ছিল। কিন্তু সেসব আজ করানগর্ভে ধ্বংসস্তূপে গ্রাস করেছে। তবে আজও তমলুকের দেবী বর্গভীমার মন্দির মানুষের কাছে পূর্ণ মহিমায় জাগ্রত। প্রাচীন পুরাণে বর্ণিত আছে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে খন্ডিত হয় সতীর দেহের বিভিন্ন অংশ। আর সেই সব অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে সেখানেই তৈরি হয়েছে দেবীর একটি করে পূর্ণ জাগ্রত মন্দির। আর সেই মতোই বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে খন্ডিত হয়ে সতীর বাম পায়ের গোড়ালি পড়েছিল প্রাচীন এই তমলুক শহরে। আর সেখানেই গড়ে উঠেছে পূর্ণ জাগ্রত এই দেবী বর্গভীমার মন্দির।

জেলা-সহ জেলার বাইরের মানুষের বিশ্বাস দেবী বর্গভীমার কাছে এসে কোনো কিছু প্রার্থনা করলে দেবী নাকি তা ফেরান না। আর এইসব বিশ্বাস মেনেই বছরের প্রত্যেক দিন ভিড় জমে তমলুকের এই মন্দিরে। ব্যক্তিগত বা কোনো সংস্থার কোনো শুভ কাজ অনুষ্ঠিত হলে প্রথমে দেবী বর্গভীমাকে পুজো দেওয়ার রীতি রয়েছে এখানকার। আর সেই রীতি মেনেই দেবী বর্গভীমাকে পুজো দিয়েই শুরু হয় তমলুকের বড় থেকে ছোট সমস্ত কালীপুজোর। আজও কালীপুজোর দিন সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে পুজো দেওয়ার ভিড় জমে দেবী বর্গভীমা মন্দিরে। যত সময় না দেবীর কাছে পুজো দেওয়া সমাপ্ত হয় ততসময় কোনো কালী পুজোরই সূচনা হয় না।

এই নিয়ম শুধু তমলুক শহরের নয়, তমলুক শহরের পাশাপাশি আশেপাশের নন্দকুমার, মহিষাদল, কোলাঘাট, চৈতন্যপুরের কালীপুজোর সংস্থাগুলি দেবী বর্গভীমাকে পুজো না দিয়ে শুরু হয় না কালীপুজোর। দেবীর সতীপীঠের এই বর্গভীমা মন্দিরে দেবী সারাবছর ভিন্ন ভিন্ন রূপে পূজিত হন। কখনও দুর্গা, কখনও কালী, আবার কখনওবা জগদ্ধাত্রী রূপে পূজিতা হন দেবী বর্গভীমা। তবে এখানকার দেবী যেহেতু কালী রূপে অধিষ্ঠিত রয়েছেন তাই প্রতিবছর কালীপুজোর দিনগুলিতে দেবীকে সাজানো হয় রাজবেশে। নতুন কাপড় ও স্বর্ণালঙ্কারে নতুন রাজবেশে সেজে ওঠেন দেবী বর্গভীমা। বছরের প্রত্যেকদিনই দেবীর জন্য থাকে শোল মাছের বিশেষ ভোগ। যা কালীপুজোর দিনেও ব্যতিক্রম হয় না। কালীপুজোর দিন শোল মাছ সহ নানা পদে সাজানো হয় দেবীর ভোগ। কথিত আছে, সতীর গোড়ালি এখানে পড়ার পর স্বয়ং বিশ্বকর্মা নাকি নির্মাণ করেছিলেন এই মন্দিরের। কিন্তু তমলুকবাসীর বিশ্বাস তৎকালীন তমলুকের ময়ূরবংশীয় রাজাই নির্মাণ করেছেন এই মন্দিরের।

জেলার ইতিহাসের বইগুলি ঘাটলে জানা যায় এই মন্দির তৈরি নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। কারোর কারোর মতে, প্রাচীন ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের সময় রাজা একজন ধীবরকে শোল মাছ ধরতে পাঠান। ধীবর মাছ ধরতে না পারায় রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। এরপর কোনোরকম জেলে জঙ্গলে পালিয়ে যায় এবং সেখানে ভীমাদেবীর সাক্ষাৎ লাভ করেন। সেখানে দেবী একটি কূপের জল ছিটিয়ে মাছগুলোকে বাঁচিয়ে তোলেন। এভাবে ধীবর প্রত্েযকদিন জ্যান্ত মাছ রাজার কাছে নিয়ে যাওয়ায় রাজা কৌতূহলী হয়ে ধীবরকে কারণ জানতে চায়। এরপর ধীবর সমস্ত কিছু বলায় কূপের ইতিহাস প্রকাশ্যে আশে। আর এর জেরে কূপিত হয়ে দেবী পাথরের মূর্তি ধারণ করেন। আর সেখানে রাজা তাম্রধ্বজ কিছু না পেয়ে পাথরের মূর্তির ওপরেই তৈরি করেন এই মন্দির।

আবার কারোর মত, ধনপতী নামে এক বণিক বণিজ্যে যাওয়ার পথে তমলুকে নোঙর করেন এবং সেখানে একজনকে সোনার পাত্র বয়ে নিয়ে যেতে দেখেন। এরপর বণিক জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন একটি কূপের জলের স্পর্শে নাকি সব পেতল সোনা হয়ে যায়। বণিক তা পরীক্ষা করেও দেখেন। এরপর তিনি যখন ফিরে আসেন তখন এই মন্দির নির্মাণ করেন। আর এই দ্বিমত নিয়েই আজকের এই বর্গভীমা মন্দির। ৬০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপত্যের ধাঁচে গড়ে ওঠা সতী পীঠের অন্যতম এই পীঠ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 2 =