হাওড়ার বাগনানে ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর শ্যুট আউটের ঘটনার তদন্তে নেমে রিয়া কুমারী ওরফে ইশা আলিয়ার স্বামী প্রকাশকে গ্রেপ্তার করল হাওড়া পুলিশ। কারণ, প্রথম থেকেই তাঁর বয়ানে তৈরি হতে থাকে ধোঁয়াশা। কারণ, তাঁর বয়ানে যে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে তা নজর এড়ায়নি হাওড়ার জেলা পুলিশ কর্তাদের। রিয়ার স্বামী প্রকাশের দাবি ছিল, খুন করা হয়েছে ঝাড়খণ্ডের অভিনেত্রী রিয়া কুমারী ওরফে ইশা আলিয়াকে। প্রকাশ যা দাবি করুন না কেন, এই ঘটনায় পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পড়ে তাঁর স্বামী প্রকাশ কুমারের ওপর। এরপর বুধবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদও চালানো হয়। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় প্রকাশকে। এদিকে হাওড়া জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, ধৃতকে বৃহস্পতিবার উলুবেড়িয়া আদালতে তোলা হবে। সূত্রের খবর, রিয়ার খুনের ঘটনা সামনে আসতেই বুধবার রাতেই মৃত অভিনেত্রীর পরিবারের লোকজন বাগনান থানায় আসেন। তাঁরা প্রকাশের নামে বাগনান থানায় লিখিত অভিযোগ দায়েরও করেন। এরপরই এদিন রাতেই প্রকাশকে গ্রেপ্তার করে বাগনান থানার পুলিশ। শুধু প্রকাশকে গ্রেপ্তারই নয়, এবার এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আঙুল উঠল প্রকাশের প্রথম স্ত্রী শ্রদ্ধার দিকেও। কারণ, বুধবার বাগনান থানায় যে অভিযোগ দায়ের করেন অভিনেত্রী রিয়ার দাদা অজয় রানা, সেখানেই প্রকাশের প্রথম স্ত্রী শ্রদ্ধা দেবীর প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠেছে রিয়ার খুনের ঘটনায় প্রথম স্ত্রী শ্রদ্ধার সঙ্গে যোগ আছে কিনা তা নিয়েও। পাশাপাশি রিয়া কুমারীর পরিবার সূত্রে খবর, প্রথম বিয়ের বিষয়ে প্রকাশ কোনও মন্তব্যই করেনি। অভিনেত্রীকে একেবারে অন্ধকারে রেখে ফের একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে সে। রিয়া এবং প্রকাশের একটি সন্তানও হয়। কিন্তু, কিছুদিন আগেই প্রকাশের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বিষয়ে জানতে পারেন রিয়া। এরপরেই প্রকাশের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্যও রিয়া প্রকাশের উপর চাপ সৃষ্টি করে বলে জানা গিয়েছে। এদিকে পাল্টা প্রকাশ রিয়াকে হুমকি দেয় এবং মারধরও করে বলে অভিযোগ। এবার ঝাড়খণ্ডের এই অভিনেত্রী খুনে প্রকাশের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছে রিয়ার পরিবার। তাঁদের সন্দেহ, প্রকাশের প্রথম পক্ষের স্ত্রী শ্রদ্ধার সঙ্গে যোগসাজস করে রিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এমন এক ঘটনার ইঙ্গিত পেতে তদন্তে নেমেছে বাগনান থানার পুলিশ। প্রসঙ্গত, শ্রদ্ধা তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন হাজারিবাগে।
প্রসঙ্গত, বুধবার ভোরে ১৬ নং জাতীয় সড়কে বাগনানের চন্দ্রপুরে মহিষরেখা ব্রিজে কাছে অভিনেত্রী রিয়া কুমারীকে তার আড়াই বছরের মেয়ের সামনে গুলি করে খুনের অভিযোগ ওঠে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধে। রিয়ার স্বামী প্রকাশ দাবি করেছিল, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় দুস্কৃতীরা তার স্ত্রীকে গুলি করে খুন করেছে। যদিও প্রকাশের বয়ানে প্রথম থেকেই নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। একটি নাচের অনুষ্ঠানের জন্য তাঁরা পোশাক কিনতে ঝাড়খণ্ড থেকে কলকাতায় আসছিলেন। যাত্রাপথে আচমকাই তিনি শৌচকর্ম করতে গাড়ি থেকে নামেন। সেই সময় ছিনতাইবাজরা রিয়ার উপর হামলা করে এবং গুলি চালায় তাঁর উপর। সেক্ষেত্রে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে কেন গুলি চালানো হল বা শীতের দিনে কেন গাড়ির জানালা নামানো ছিল আর যে সময়ে প্রকাশ গাড়ি থেকে নামলেন ঠিক সেখানেই দুষ্কৃতীদের হাতে তিনি কেন চড়াও হলেন এই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দিতে পারছিলেন না প্রকাশ। এছাড়াও আরও একাধিক প্রশ্নের ক্ষেত্রের উত্তরের সঠিক উত্তর মেলেনি প্রকাশের তরফ থেকে। এর পাশাপাশি সূত্রে এ খবরও মেলে যে, রিয়া প্রকাশের দ্বিতীয় স্ত্রী। সামনে থেকে এই দম্পতিকে সুখী মনে হলেও আদতে তাঁদের মধ্যে একাধিক সমস্যা ছিল বলে পরিবারের দাবি। কেরিয়ারেও রিয়া বেশি সফল ছিল। সেক্ষেত্রে কোনওভাবে কি স্ত্রীর সাফল্য মেনে নিতে পারেনি প্রকাশ তা নিয়েই উঠছিল প্রশ্ন। আর রিয়াকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল প্রকাশের পরিবারেও। কারণ, রিয়ার গ্ল্যামারস জীবনযাপন মানতে পারছিলেন না শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। সূত্রের খবর, তাঁরা চাইছিলেন রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে প্রথম স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনুক প্রকাশ। এনিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, প্রথম পক্ষের স্ত্রীয়ের সঙ্গে আবার প্রকাশের পরিবারের সম্পর্ক ভাল। আবার রিয়ার আচার-আচরণেও ক্ষুব্ধ ছিল প্রকাশের পরিবার। শুধু তাই নয়, এদিকে প্রকাশের বাজারে বিস্তর দেনাও হতে থাকে। অন্যদিকে রিয়ার নামে থাকা মোটা অঙ্কের জীবন বিমার নমিনি ছিলেন এই প্রকাশ। হত্যার পিছনে এই সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারী আধিকারিকেরা। ফলে সব মিলিয়ে পুলিশের প্রাথমিক ধারনা, প্রকাশের হাতেই খুন হয়েছে ঝাড়খণ্ডের অভিনেত্রী রিয়া কুমারী ওরফে ইশা আলিয়া।
এদিকে রিয়ার দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় বুধবারই। এরপর ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট ইতিমধ্যেই পুলিশে হাতে তুলেও দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, পুলিশের অনুমান পরিকল্পিতভাবেই রিয়া কুমারীকে খুন করা হয়েছে, এমনটাই ধারনা তদন্তকারী আধিকারিকদের। পুলিশ সূত্রে খবর, রিয়া কুমারীর দেহ গাড়ির মধ্যে শোয়ানো অবস্থায় ছিল। আর এখানেই প্রশ্ন, রিয়াকে কি ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করেছে প্রকাশ নাকি এই খুনের পিছনে রয়েছে অন্য কারও হাত তা নিয়েও। তারই উত্তর খুঁজতে বৃহস্পতিবার হাসপাতালের মর্গে রিয়া কুমারীর ফরেন্সিক পরীক্ষা করা হবে। কারণ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা চান, এই ঘটনায় যাবতীয় নমুনা সংগ্রহ করতে। জানা গিয়েছে, রিয়ার মাথার ডান দিকে কানের নীচে গুলি লেগেছিল। সেই অংশ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে। সেখানকার চামড়াও নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করবে ফরেন্সিক টিম। পাশাপাশি পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃত রিয়ার স্বামী যে সময়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন সেই সময় আদৌ খুন করা হয়েছিল না তার আগে হত্যা করা হয়, তা খতিয়ে দেখবেন ফরেন্সিক দলের সদস্যরা। প্রকাশের গাড়ি থেকে গুলির খোল পাওয়া গেলেও তাঁকে গাড়িতে খুন করা হয়েছে কিনা, সেই বিষয় নিয়ে এখনও নিশ্চিত নন তদন্তকারী অফিসাররা। তাই রিয়ার দেহের পাশাপাশি প্রকাশের গাড়ির ফরেন্সিক পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।