রক্ষাকর্তা হিসাবে চক্রবর্তী বাড়ি পাহারা দেন আরামবাগের মা সিদ্ধেশ্বরী

হুগলি জেলার আরামবাগের কালীপুর এলাকার চক্রবর্তী বাড়ির ঐতিহ্যবাহি কালীপুজোকে ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস, যা আজও এলাকার মানুষের মনকে নাড়া দেয়। চক্রবর্তী বাড়িতে মা কালী সিদ্ধেশ্বরী রূপে পূজিত হন। মা সিদ্ধেশ্বরী রক্ষাকর্তা হিসাবে সর্বদা চক্রবর্তী বাড়ির প্রতিটি পরিবারকে পাহারা দিয়ে আসছেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে ডাকাত দলও চক্রবর্তী বাড়ির কোনও ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে না। এমনটাই কথিত আছে আরামবাগের কালীপুর এলাকার আনাচে-কানাচে। মায়ের মহিমায় এখনও পর্যন্ত কোন ডাকাত বা চোরের দল কালীপুরের ওই চক্রবর্তী বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি। আর কয়েকদিন পরেই কালীপুজো। প্রায় ৩০০ বছর ধরে রীতিমেনে পুজোপাঠ হয়ে আসছে আরামবাগের কালীপুর এলাকার চক্রবর্তী বাড়ির সিদ্ধেশ্বরী কালীর। বছরে দু’বার পুজো হয় মায়ের। কার্তিক মাসে এবং জৈষ্ঠ মাসে মা সিদ্ধেশ্বরী কালীর পুজো পাঠ হয়। তবে নিত্যদিন মায়ের আরাধনা করেন ওই বংশের বংশধরেরা। মা সিদ্ধেশ্বর কালী পঞ্চমুণ্ডির আসনে অধিষ্ঠিত।

কথিত আছে, একবার গভীর রাতে একদল ডাকাত ওই চক্রবর্তী বাড়িতে ডাকাতি করতে আসেন। সেই সময় জঙ্গল ঘেরা দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে কালীপুর জনপদ গড়ে ওঠে। লোক বসতিও কম ছিল। তাই মানুষকে রাতে ডাকলেও সহজে সাড়া পাওয়া যেত না। এইরকম পরিস্থিতিতে ডাকাতের দল যখন চক্রবর্তী বাড়ির প্রধান ফটকে হাজির হয় তখন তারা দেখেন লাল পাড় শাড়ি পড়ে একজন মহিলা প্রধান ফটক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। পিছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ থেকে করতে গেলে একইভাবে লাল পাড় শাড়ি পরা একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিছুতেই তাকে সরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করা যায়নি। ডাকাত দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুটি দরজার সামনে যাওয়ার পরেও একই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায়। চোখ ধাঁধানো জ্যোতি ওই মহিলার শরীর থেকে বের হতে থাকে। ভয়ে ও আতঙ্কে ডাকাত দল সেই স্থান ত্যাগ করে। পরের দিন সকালে চক্রবর্তী পরিবারের সিদ্ধ পুরুষ কানাইলাল চক্রবর্তীর কাছে ডাকাত দল ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং মা সিদ্ধেশ্বরীর মহিমার কথা বলেন। এই কথিত কাহিনির কথা জানান বর্তমান বংশধর রণজিৎ চক্রবর্তী।

জানা গিয়েছে, ওই পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা প্রথম গোঘাটের জয় কৃষ্ণপুর মায়ের পুজোপাঠ শুরু করেন। তারপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওখান থেকে একটি পরিবার কালীপুর জনপদে এসে মায়ের পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে পুজো পাঠ শুরু করেন। বামাচরণ ভট্টাচার্য নামে একজন সিদ্ধ পুরুষ ঘটা করে পুজোপাটের আয়োজন করেন। তার আগে নিয়ম মেনে মায়ের আরাধনা হলেও সেইভাবে সাড়ম্বর ছিল না।

বর্ধমানের রাজা মা সিদ্ধেশ্বরী মায়ের প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পেরে জমিদান করেন চক্রবর্তী পরিবারকে। শোনা যায় বামাচরণ চক্রবর্তী যিনি পরে ভট্টাচার্য উপাধি পান তিনি পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে মায়ের অভিষিক্ত ঘটে ফুল দিতেন তখন হঠাৎ করে একটি সাপের উদয় হত। তারপর ঝাঁঝ ঘণ্টা ও শঙ্খ ধ্বনি হাতে সাপটি বাবা শিবের পেট দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। তাছাড়া ১৯৭৮ সালের বন্যার সময় মা মুর্তি যখন ভেঙে পড়ে তখন একটি দিব্যজ্যোতি বের হয় এবং গোটা চক্রবর্তী পরিবারের যে সমস্ত সদস্য মা কালীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন তারা অন্ধকার দেখেন। এরপর মা সিদ্ধেশ্বরীর মূর্তি করার জন্য স্থানীয় মৃৎশিল্পীকে ডাকা হয়। কিন্তু তিনি কিছুদিন কাজ করার পরেই পলায়ন করেন। মায়ের স্বপ্নদেশ পেয়ে ওই পরিবারের এক বংশধর মৃৎশিল্পী খুঁজতে বের হন। অপরদিকে গোঘাটের বদনগঞ্জ এলাকার মৃৎশিল্পীয় মায়ের স্বপ্ন দেখতে আরামবাগে হাজির হন। মা কালী আশীর্বাদে দুই ব্যক্তির সাক্ষাৎ হওয়ার পর সিদ্ধ আচারে মা কালীর পুনরায় মূর্তি নির্মিত হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × five =