গরু পাচার মামলায় দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে যে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করেছে তাতে সামনে এল শক্তিগড়ে খাবারের দোকানে ‘মিটিং’য়ের ঘটনারও। ইডির তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, দিল্লি যাওয়ার সময় সুকন্যার নির্দেশেই শক্তিগড়ে অনুব্রতর সঙ্গে খাবারের দোকানে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের ঘনিষ্ঠ তুফান মৃধা এবং কৃপাময় ঘোষ। এমনকী চার্জশিটে তুফানের দেওয়া বয়ানের উল্লেখ করে ইডি-র তরফ থেকে এও জানানো হয়েছে, ইডিকে দেওয়া বয়ানে তুফান জানিয়েছেন, আসানসোল জেলের এক জেলারের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন, পুলিশের গাড়ি শক্তিগড়ে দাঁড়াবে। অনুব্রত দিল্লি যাওয়ার আগে সুকন্যা মণ্ডলের নির্দেশেই তাঁরা দেখা করেন। আর সেই সাক্ষাৎ হয় পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে।
এছাড়াও রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে ইডি-র তরফ থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, ভুয়ো মামলায় অনুব্রতকে দুবরাজপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাতে রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ইডি। সেই অভিযোগও করা হয়েছে চার্জ শিটে। ইডিকে এড়াতে এবং নিজের পক্ষে রায় পেতে কলকাতা, দিল্লি, সব হাইকোর্টে অনুব্রত মণ্ডলের করা পর পর মামলার প্রসঙ্গও রয়েছে চার্জশিটে।
ইডির অভিযোগ, প্রথম থেকেই তদন্তে অসহযোগিতা করেছেন অনুব্রত মণ্ডল। নিজের অ্যারেস্ট মেমো থেকে শুরু করে বিভিন্ন নথি অনুব্রত সই করতে অস্বীকার করেন বলেও উল্লেখ রয়েছে চার্জশিটে। অর্থাৎ, ইডি সূত্রে যে খবর মিলছে তাতে অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বিদ্যুৎবরণ গায়েন, রাজীব ভট্টাচার্য, বিশ্বজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে মুন, অনুব্রত মণ্ডলের গাড়ির চালক শেখ আনারুল, ওমর শেখ থেকে শুরু করে তুফান মৃধার মতো অনুব্রত-ঘনিষ্ঠদের বয়ানই আরও সমস্যায় ফেলছে অনুব্রতকে।
এখানে বলে রাখা শ্রেয়, ইডি ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং’-এর তদন্ত করছে। যার সঙ্গে এই ঘটনার যোগ থাকার কথা নয়। এরপরও এই ঘটনাগুলোর উল্লেখের কারণ হল, ইডি বোঝানোর চেষ্টা করছে অনুব্রত কতটা প্রভাবশালী। জেলবন্দি অবস্থাতেও তিনি প্রশাসনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।
এদিকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট তাতে অনুব্রত মণ্ডলের পাশাপাশি নাম রয়েছে সুকন্যা মণ্ডলেরও। শুধু তাই নয়, একের পর এক নয়া তথ্য সামনে আনা হয়েছে ইডির এই চার্জশিটে। একইসঙ্গে ইডি এই চার্জশিটে উল্লেখ করেছে, ব্যাঙ্ক ও আয়কর বিভাগের নজরদারি এড়াতে একাধিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করার ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক যাতে বেশি না দেখায় তার জন্য রাউন্ড ফিগারে টাকা জমা না করে ১ টাকা করে কম জমা দিতেন। যেমন ৫০ হাজার জমা না করে ৪৯,৯৯৯ টাকা জমা করা হতো। ১ লক্ষ টাকা জমা না করে ৯৯,৯৯৯ জমা করা হতো। ২ লাখের জায়গায় জমা করা হতো ১,৯৯,৯৯৯ টাকা।
ইডি সূত্রে খবর, গরুপাচারের টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও অভিনব কৌশল নেওয়া হয়। মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিতে গেলে যিনি তা জমা করতে যান, তাঁকে প্যান কার্ড দেখাতে হয়। ফলে তাঁর পরিচয় সামনে এলে ভবিষ্যতে সমস্যার মধ্যে পড়তে হতে পারে। তাই ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে গিয়ে টাকা জমা দেওয়ার বদলে ‘ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন’-এ মোটা অঙ্কের টাকা জমা দেওয়া হতো।
এরই পাশাপাশি ইডি-র এই চার্জশিটে লটারিকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করেছে। একাধিক লটারির পুরস্কার জেতা আসলে গরু পাচারের কালো টাকা সাদা করার কৌশল ছিল বলে দাবি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থার তরফ থেকে। অনুব্রত মণ্ডল ও সুকন্যা মণ্ডল ১০-১২ বার লটারি জেতেন। এখনও অবধি ২ কোটি টাকার হিসাব পাওয়া গিয়েছে। দু’বার তাঁরা ৫০ লক্ষ টাকা করে এবং আরেকবার ১ কোটি টাকা জেতেন বলে ইডি চার্জশিটে উল্লেখ করেছে। তবে এই টাকার অঙ্ক আরও বেশি বলে মনে করছে ইডি।
একইসঙ্গে ইডি-র তরফ থেকে এও দাবি করা হয়েছে, অনুব্রত মণ্ডলের ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের মোট ২৪টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় ১৩ কোটি টাকা রয়েছে। সঙ্গে এও দাবি, অনুব্রত, তাঁর প্রাক্তন দেহরক্ষী সায়গল হোসেন মারফত বোলপুরের স্থানীয় নেতাদের নথি নিয়ে বেনামে একের পর অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। আর অনুব্রতর নামে ও বেনামে অন্তত ২৪টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকেই হাত বদল হয়েছে গরু পাচারের কোটি কোটি টাকা। একইসঙ্গে চার্জশিটে ইডি-র তরফ থেকে এও জানানো হয়েছে যে, অনুব্রত মণ্ডলের ও তাঁর নিকট আত্মীয়দের নামে যে ২৪টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তার মধ্যে মাত্র ৬টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে অনুব্রতর নিজের নামে। অনুব্রতর স্ত্রী ছবি মণ্ডলের নামে ছিল একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। স্ত্রী ছবি ও অনুব্রতর জয়েন্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল একটি। স্ত্রী ও মেয়ে সুকন্যার নামেও ছিল একটি জয়েন্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের নামে ছিল সাতটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।
এছাড়া এএনএম অ্যাগ্রো ফুড প্রাইভেট লিমিটেডের নামে একটি, ভোলে বোম রাইস মিলের নামে দুটি ব্যাংক একাউন্ট, শিব শম্ভু রাইস মিলের নামে দুটি অ্যাকাউন্ট। এছাড়াও, কালী মাতা ট্রেডার্স একটি, মা দুর্গা ট্রেডাস একটি , নীর ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেড-এর নামে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। পাশাপাশি ইডির চার্জেশিটে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এমন ২৪টি অ্যাকাউন্ট থেকে মোট ১২ কোটি ৮০ লক্ষ ৯৮ হাজার ২৩৭ টাকার হদিস মিলেছে।
এছাড়াও, অনুব্রত মণ্ডল বেনামে পরিচারক বিজয় রাজক ও বোলপুরে তৃণমূল স্থানীয় নেতার নামেও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন বলে চার্জশিটে দাবি করেছে ইডি। অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশে সায়গল হোসেনের কথাতেই অনুব্রতর পার্সোনাল সিকিওরিটি অফিসার এবং স্থানীয় বোলপুরে তৃণমূলের কর্মীদের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হত বলে অভিযোগ। ইডির চার্জশিট অনুযায়ী, বেনামে যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মারফত টাকা ঘোরানো হতো, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিজয় রজোক, তাপস মণ্ডল, অর্ক দত্ত, শ্যামাপদ কর্মকার, আশিস মণ্ডল, সঞ্জিত কুমার রায়, শঙ্করী প্রসাদ গাঙ্গুলি, শান্তনু সেন, ওমর শেখ। বিদ্যুৎ বরণ গায়েন ও বিশ্বজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও এঁদের নামে বেনামি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। পাশাপাশি ইডির তরফ থেকে এও দাবি করা হয় যে, এঁরা নিজেদের নথি ও ব্ল্যাঙ্ক চেকে সই করতেন অনুব্রত মণ্ডলেরই নির্দেশে৷ গোটা বিষয়টি দেখাশোনা করতেন অনুব্রতর প্রাক্তন দেহরক্ষী তথা গরু পাচার কাণ্ডে ধৃত সায়গল হোসেন৷ কোনখানে কত টাকা জমা হচ্ছে ও কত তোলা হচ্ছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের। অনুব্রতর নামে ও বেনামে এতো গুলো অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা গরু পাচারে হাত বদলে এসেছে বলে দাবি ইডির। এর পাশাপাশি চার্জশিটে এও দাবি করা হয় যে, বীরভূমে পশু হাট বাজার থেকে গরু পাচারের মূল দায়িত্বে ছিল শেখ আবদুল লতিফ। বীরভূম থেকে মুর্শিদাবাদের গোটা সিস্টেম, অর্থাৎ, গরু হাট থেকে গরু সংগ্ৰহ থেকে শুরু করে তার ট্রান্সপোর্ট সব কিছুই আবদুল লতিফ দেখভাল করতেন।
সূত্রের খবর, গরু পাচার কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত এনামুল ও তাঁর ভাইপো জাহাঙ্গীর আলম, হুমায়ুন কবির, মেহেদি হাসানের কোম্পানি জেএইচএম ব্রাদার্স-এর কর্মচারি মনোজ সানার ডায়েরি থেকে মিলেছে এই তথ্য। এই ডায়েরি থেকেই জানা গিয়েছে আবদুল ঘনিষ্ঠ শেখ আনোয়ারকে বিভিন্ন তারিখে মোট ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল।
পাশাপাশি চার্জশিটে এও উল্লেখ করা হয়েছে, বীরভূম থেকে আবদুলেরই নির্দেশে বিভিন্ন সময় হাটে গরু সংগ্রহ করা হত। এদিকে এই আবদুল লতিফ ও এনামুল হক, দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অনুব্রত মণ্ডলের প্রাক্তন দেহরক্ষী তথা গরু পাচার কাণ্ডের অন্যতম মূল অভিযুক্ত সায়গল হোসেনের। ইডি-র দাবি, অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশেই তাঁর হয়ে প্রোটেকশন মানি সংগ্রহ করত সায়গল। গরু পাচার করে ট্রাক ভর্তি করে মুর্শিদাবাদে এনামুল হক ও জেএইচএম ব্রাদার্স-এর সোনার বাংলা অফিসে পাঠানো হত। পরে এটি মার্বেল শপে পরিণত হয়।