মহেশ্বর চক্রবর্তী
ভারতবর্ষ মানেই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। অতিপ্রাচীন কাল থেকেই তার নজির দেখা গিয়েছে বারে বারে। আসলে ভারতের ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য প্রাচীন ও প্রবাহমান।
বিশেষত, বাংলার আনাচে কানাচে এমন অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই রকম অনেক উদাহরণই আবার জড়িয়ে আছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। তেমনই এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ তৈরি হয়েছে আরামবাগের ভালিয়া এলাকার সরকার বাড়ির বনেদি আনায় পূর্ণ দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে।
কেন এই পুজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ? তার কারণ শেষ সাড়ে তিনশো বছর ধরে এই পুজো শুরু হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নমাজের সুরের সঙ্গে। মুসলিমরা নমাজ পড়া শেষ করলে হয় আরতি, শুরু হয় পুজো। মা দুর্গার আবাহনে এই রীতিই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ৩৫০ বছর আগে এই পুজো শুরু করেছিলেন জমিদার বাবুরাম সরকার। তাঁর জমিদারিতে ছিলেন অনেক মুসলিম মানুষ। বাবুরাম নিজে খোলা মনের মানুষ ছিলেন, তাই তাঁদেরও নিজের সংßৃñতির মধ্যে জায়গা করে দিয়েছিলেন। দুই সম্প্রদায় মিলে মিশে দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যখন জাতপাতের বিচার সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কী করে এতটা প্রগতিশীল চিন্তা করতেন তাঁরা। ২১ শতকে দাঁড়িয়েও হয়ত কেউ কেউ এই ভাবনা ভাবতে পারেন না, যা তখন ভেবেছিলেন বাবুরাম।
সেই থেকে সপ্তমীতে নমাজ পাঠের মাধ্যমেই পুজোর শুরু করে আসছেন সরকার পরিবার। অষ্টমী, নবমীতেও নমাজ পড়ার পর শুরু হয় পুজো। এই পুজো মণ্ডপে শেখ মতলেব নামে স্থানীয় এক মুসলিম শেষ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে পুজোর আগে নমাজ পড়ে আসছেন। সরকার পরিবার আজও এই রীতি বজায় রেখেছেন। আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বার্তা দিতেই এই প্রথার আরম্ভ, এমন মনে করেন অনেকেই। স্থানীয় বাতানল গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য নির্মাল্য পোড়েল জানালেন, বর্তমানে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিতে যেখানে হারিয়ে যেতে বসেছে মানবতা, সেখানে সরকার বাড়ির পুজো সত্যিই নজির তৈরি করেছে। অপরদিকে সাযুর্জ্য সরকার জানান, এই পুজোয় আজও বলি প্রথার প্রচলন রয়েছে। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী এই তিনদিনই পাঁঠাবলি হয়। তার মধ্যে অষ্টমীর দিন বলি হয় কালো পাঁঠা। এছাড়াও পুজোর রীতি মেনে দশমীর দিন চ্যাং মাছ বলি হয়। সন্ধিপুজোর ১০৮টি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন পরিবারের মহিলারা। সবমিলিয়ে আরামবাগেরই ভালিয়া গ্রামে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন সরকার বাড়ির দুর্গাপুজোতে আজও অটুট সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন।