জনশ্রুতি আছে, ব্রম্ভ্যদৈত্যকে শান্ত করার জন্য হর পার্বতীর পুজো হয় আরামবাগের নন্দী বাড়িতে

মহেশ্বর চক্রবর্তী

আজও প্রতিপদে জমিদার বাড়ির রাজ শঙ্খের আওয়াজ জানান দেয় মা দুর্গার পুজোপাঠের সূচনা হয়ে গেল। এলাকার মানুষ রীতি মেনে প্রতিবছর মহালয়ার পূণ্য তিথিতে জমিদার বাড়ির নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী রাজ শঙ্খ আওয়াজ শোনেন। আর দালান বাড়িতে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। এখনও সেই রীতি চলে আসছে হুগলির হাট বসন্তপুরের নন্দী জমিদার বাড়ির দালানে। তারই প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে।
এই জমিদার বাড়িতে মা দুর্গার দশভুজা রূপের পরিবর্তে, হর পার্বতী রূপে শিব ও দুর্গা এবং তার সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের পুজোপাঠ হয়। কিন্তু শরৎকালীন এই দুর্গা পুজোয় অসুর যে মায়ের সঙ্গে পূজিত হন তা কিন্তু নন্দী জমিদার বাড়িতে দেখা যায় না। কেবল শিব ও দুর্গার সঙ্গে তাদের ছেলে মেয়েরা জমিদার বাড়িতে পূজিত হন। হাটবসন্তপুরের নন্দী জমিদার বাড়ির হর পার্বতীর পুজোকে কেন্দ্র করে নানা অলৌকিক ঘটনা ও ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এখনও জমিদার বাড়ির বিশাল আকারের দালান বাড়ি রয়েছে। তবে সেই জৌলুশ হয়তো হারিয়েছে। রং-বে রঙের ঝাড়বাতি, হ্যাচাক লাইট হয়তো নেই। কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্যময় জমিদার বাড়ির বিরাট দালান, জমিদার বাড়ির বিরাট ফটক, ঐতিহ্যময় দিঘির ঘাট, জমিদারের শয়নকক্ষ সবই বর্তমান আছে। তবে সবই ভগ্নপ্রায় অবস্থায়। তবে জমিদার বাড়ির দালানে এখনও বিরাট হর পার্বতীর মন্দির এবং বেদি প্রতিষ্ঠা করা আছে। আর বেদির ওপর বসানো আছে রাজ শঙ্খ। প্রতিপদে এই রাজ শঙ্খপর ধ্বনি আকাশে বাতাসে মুখোরিত হয়ে ওঠে। দেবীর আগমন বার্তায় গোটা জমিদার বাড়ির পবিত্র হয়ে ওঠে মায়ের পদস্পর্শে। এই জমিদার বাড়ির একজন প্রবীণ সদস্য জানান, এই পুজোর বয়স বলা খুব মুশকিল। পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি প্রায় ৬০০ বছর আগে এই পুজোর সূচনা হয়। রাজ শঙ্খ বাজানোর পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়ি করে দুই মন খাদ্য দ্রব্য ধরে এই রকম তামার জালায় করে কলকাতা নগরী থেকে গঙ্গা জল এনে প্রতিপদে পুজোর সূচনা হত। এখনও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে রাজ শঙ্খ বাজানো হলেও ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে আধুনিক যান ব্যবহার করার পাশাপাশি এক টিন গঙ্গা জল এনে পুজোপাঠের সূচনা হয়। তাছাড়া এই জমিদার রাজপরিবারের নথি থেকে জানতে পারা গেছে, বর্ধমানের এক প্রাচীন জনপদ থেকে উঠে এসে মুণ্ডেশ্বরীর নদীর তীরে জমিদারীর পত্তন করেন আশুতোষ নন্দী। কিন্তু জমিদার বাড়ির উত্তর উত্তর শ্রীবৃদ্ধি হলেও মানসিক শান্তি ছিল না জমিদারের। তাই তিনি জমিদার বাড়িতে প্রথম নারায়ণের পুজো শুরু করেন। কিন্তু তাতেও অস্থির ভাবে দিন কাটতো তার। একদিন হঠাৎ এক সিদ্ধ পুরুষ জমিদার বাড়িতে এসে জমিদারকে নাকি জানান এই জমিদার বাড়িতে ব্রম্ভদৈত্য আছে। সে প্রতি রাতে নারায়ণের পুজো করে দালান বাড়ির মন্দির থেকে চলে যায়। এর কয়েক দিন পরেই জমিদার বাড়ির প্রধান ফটকের করিদড়ে গলা টেপা অবস্থা দারোয়ানে মৃতদেহ দেখা যায়। জমিদার ভয়েü মা দুর্গার স্মরণাপন্ন হন। একদিন স্বপ্নাদেশে মা দুর্গা জমিদারকে বলেন, ব্রম্ভ্যদৈত্যকে শান্ত করার জন্য এবং এই জমিদারিকে রক্ষা করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুজোপাঠের পাশাপাশি হর পার্বতীর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই থেকেই জমিদার শিব ও দুর্গার পুজো শুরু করেন। এমনটাই দাবি জমিদারবাড়ির প্রবীণ সদস্যদের। অপরদিকে এই জমিদার বাড়ির কুলবধূ বাসন্তী নন্দী জানান, শ্বাশুড়ি নাকি বলতেন এই প্রতিপদ থেকেই গভীর রাতে এই দুর্গা দালানের চারপাশে মা দুর্গার নুপূরের ধ্বনি শোনা যেত। আর সকাল থেকেই জমিদার বাড়িতে আর কোনও ভয়ের পরিবেশ থাকত না। সবমিলিয়ে হুগলির এই হাটবসন্তপুরের নন্দী জমিদারবাড়ির পুজোকে ঘিরে এখনও ব্রম্ভদৈত্যের জনশ্রুতি রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − five =