মহেশ্বর চক্রবর্তী
ওডিশার পুরীর রথের পর সব থেকে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রথ হল হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ। এই বছর এই ঐতিহ্যবাহী রথ ৬২৬ বছরে পদার্পণ করল। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে এই বছর সাড়ম্বরে পালিত হয় শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা। এদিন গর্ভগৃহ থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে নিয়ে আসা হয় ভক্তদের জন্য। করোনা পরিস্থিতির বিধি নিষেধ উঠে যাওয়ায় এই বছর ধুমধাম করে পালিত হয় মাহেশের রথ যাত্রা। অসংখ্য পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। করোনা আবহে দু’বছর বন্ধ ছিল মাহেশের রথ। তবে শুক্রবার জগন্নাথ দেবের পুজো দিতে উপস্থিত শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মদন মিত্র, শোভন চট্টোপাধ্যায় ও ইন্দ্রনীল সেন-সহ বিশিষ্টজনেরা। এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাধ থেকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর শহরের মাহেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এদিন শ্রীরামপুরের মাহেশ জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির থেকে মাহেশ গুন্ডিচা মন্দির অবধি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার ৫০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাচীন ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলেই জানা যাবে, মাহেশের রথযাত্রা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, ‘ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামেতে এক গ্রাম আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেব। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পূজা করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।’ এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও পরবতীকালে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শ্রীচৈতন্য পুরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে তিনি মাহেশে পৌঁছে ছিলেন। ধ্রুবানন্দের মন্দির পরিদর্শন করার পরে তিনি তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং গভীর সমাধিতে মগ্ন হন। শ্রীচৈতন্য মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ অর্থাৎ ‘নতুন পুরী’ বলে নামকরণ করেছিলেন। এই পবিত্র ভূমিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তার স্ত্রী মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অনেক মানুষ রথের বিখ্যাত মেলা পরিদর্শনে এসেছিলেন। আসলে মাহেশের রথযাত্রা ঘিরে নানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এদিম মাহেশের রথ যাত্রায় সামিল হন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও ভক্তি ভরে ভগবান জগৎনাথদেবকে পুজো দেন। সবমিলিয়ে এদিন মাহেশের রথ ঘিরে পুণ্যার্থীদের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।