কলকাতা : ট্যাংরা থানা এলাকায় মঙ্গলবার রাতে নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হলেন বিজেপি নেতা রাকেশ সিং। সেই গ্রেফতারিকে কেন্দ্র করে ফের তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্গন। কলকাতা পুলিশ রাকেশ সিং-এর নামে একের পর এক মামলা ও নতুন নতুন ধারা চাপিয়েছে। শুধু অস্ত্র আইনের সেকশন ২৫ ও ২৭ নয়, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে Prevention of Insults to National Honour Act এবং ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (BNSS)-এর ধারা ১০৯, ১১৫(২), ১১৮(১), ২২৬(২), ৩(৫), ৩২৪(২), ৩২৬, ৩২৯(৪), ৩৫১ ও ৭৯। পুলিশের দাবি, এটি একটি “multiple charges” মামলা—যার মধ্যে ষড়যন্ত্র, প্ররোচনা, গুরুতর আঘাত এবং অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে।
কিন্তু পুলিশের দেওয়া এই ধারাগুলির সারবত্তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। আইনজীবীদের মতে, অস্ত্র আইনের ধারা টেকাতে হলে অভিযুক্তের কাছ থেকে অনুমতিহীন অস্ত্র উদ্ধার আবশ্যক, যা এই ক্ষেত্রে হয়নি। জাতীয় পতাকা দগ্ধ হলে Prevention of Insults to National Honour Act প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু দলীয় পতাকা পোড়ানোর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। উপরন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা ভিডিও না থাকলে আদালতে এই মামলা দুর্বল হয়ে যাবে।
একইভাবে BNSS-এর ধারা ১০৯ (অপরাধে প্ররোচনা) ও ১১৫(২) (ষড়যন্ত্র) সম্পূর্ণ প্রমাণসাপেক্ষ। ৩২৪(২), ৩২৬ (গুরুতর আঘাত) ও ৩৫১ (আক্রমণ)-এর মতো ধারাগুলি তখনই টিকে যদি অভিযুক্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন—যা এখানেও প্রশ্নের মুখে।
এই ঘটনায় রাকেশ সিংয়ের ছেলে ও পরিবারের উপর পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সোমবার রাতে রাকেশ সিং-এর বাড়িতে গিয়ে তিনি বলেন—“রাকেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, কারণ উনি অন-ক্যামেরা ছিলেন। পারলে গ্রেফতার করুন, জেল খাটান। রাকেশও আইনি পথে লড়াই চালিয়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ওর ছেলে তো ঘটনাস্থলে ছিল না। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে মারধর করা হচ্ছে, তারপরও তুলে নিয়ে যাওয়া হল। এটা কী?”
তিনি সরাসরি পুলিশের বিরুদ্ধে পরিবারের মহিলা সদস্যদের উপর হামলার অভিযোগ আনেন—“দু’জন মহিলাকে আক্রমণ করেছে। হাতগুলো কেটে কেটে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। বাচ্চা মেয়েটারও উপরে হামলা চালিয়েছে। এটা পুলিশ?”
শুভেন্দু শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকাও তুলে ধরেন—“আসামী কেন, তার বাড়ির লোকের গায়েও হাত দেওয়া যাবে না। রাকেশ অপরাধী নয়, সে রাজনৈতিক কর্মী।” পরিশেষে তিনি ঐক্যের বার্তা দেন—“এবার আমাদের কেউ ভাগ করতে পারবেন না। ভাষার নামে, জাতের নামে, হিন্দি-বাঙালি বলে আর ভাগ করা যাবে না। আমরা সকলে সনাতনী, আমরা সকলে এক।”
বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন—“বিজেপি কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা পড়ানোতে বিশ্বাসী নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর মাকে যেভাবে অপমান করা হয়েছে, যে কোনও কর্মী আবেগতাড়িত হতেই পারেন। একে সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা উচিত।” তাঁর অভিযোগ, রাজ্য পুলিশ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বাড়াবাড়ি করছে।
পুলিশের ভূমিকা কতটা আইনত সঠিক?
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিএনস-এর ধারা ৩৫ (পূর্বতন CrPC সেকশন ৪১)-অনুযায়ী গ্রেফতারের আগে লিখিত কারণ জানানো বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক ডি.কে. বসু বনাম স্টেট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে—গ্রেফতারের সময় পরিবারের কাউকে মারধর করা যাবে না। শুভেন্দুর অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তবে পুলিশের এই অভিযান কেবল BNSS লঙ্ঘন নয়, মানবাধিকার ভঙ্গের শামিল। মহিলা ও শিশুর উপর হামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে BNSS-এর IPC-সমতুল্য ধারায় মামলা হতে পারে এবং এনএইচআরসি-তেও অভিযোগ জানানো সম্ভব।
বিজেপির অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে রাকেশ সিংকে দীর্ঘদিন জেলে রাখার জন্য ধারার পাহাড় চাপাচ্ছে, যাতে ইন্ডি জোটের সঙ্গী কংগ্রেসকে খুশি রাখা যায়। বিজেপি এই পদক্ষেপকে “অপোজিশন মুজলিং” বলে অভিহিত করেছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—কলকাতা হাই কোর্টে জামিন আবেদন করা, দুর্বল ধারাগুলি চ্যালেঞ্জ করা এবং এনএইচআরসি-তে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা—এটাই রাকেশ সিংয়ের পক্ষে সবচেয়ে কার্যকর আইনি পথ হতে পারে।

