‘বুট পুজো’-র মাধ্যমেই ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে মাতৃ আরাধনা মৌড়ির কুণ্ডুচৌধুরী পরিবারে

‘বুট পুজো’ নামটা শুনলে সনাতনীদের দুর্গাপূজার রীতি আচারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বলেই অনেকের মনে হয়। যদিও এই ‘বুট’ শধটি ইংরেজি শধ নয়, প্রকৃতপক্ষে এটা বোট শধের অপভ্রংশ হয়ে বুট হয়ে গেছে। আর এভাবেই শতকের পর শতক ধরে ‘বুট পূজার’ বিশেষ ঐতিহ্যকে আঁকড়ে বাঁচিয়ে রেখে প্রতি বছর শরৎকালে হাওড়ার মৌড়ির কুণ্ডুচৌধুরী বনেদি বাড়ির পরিবার মাতৃ আরাধনায় ব্রতী হন । এ বাড়িতে বছরে দু’বার দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। একবার শরৎকালে আর অপরটি বসন্তকালে বাসন্তীর আরাধনা হয়। যদিও পরিবারের ইতিহাস বলছে এই বাড়িতে বাসন্তী পুজো আগে থেকে শুরু হলেও শরৎকালের মাতৃ আরাধনার প্রাচীনত্ব ৩০০ বছরের।

আজ থেকে ৩০০ বছর আগে এই বংশের জমিদারি তালুক ছিল হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান ও দুই ২৪ পরগনায। এত বড় তালুকের জমিদারির রক্ষনাবেক্ষনের জন্য সেই অতীতে জলপথই একমাত্র ভরসার স্থান ছিল। পাশপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্যও করতে যেতেন এই জমিদার পরিবারের সদস্যরা। অতীতের সেই দুর্গম, বিপদসঙ্কুল নদীপথে নানা বিপদ ওত পেতে থাকতো। তাই বাণিজ্যে যাওয়া পরিবারের সদস্য ও নৌকার মঙ্গল কামনাতে সমস্ত বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই কুন্ডুচৌধুরী বাড়িতে শরৎ কালে দুর্গাপুজো শুরু হয় । আর সেই থেকে ৩০০ বছর ধরে আজও এই দুর্গাপূজাতে প্রাচীন নিয়ম , রীতি ও আচার মেনে দশমীর দিনেতে বোট পুজো করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত সময়ে নদীপথে বাণিজ্য বহু অতীতে বিলুপ্ত হলেও বোট পুজোর রেওয়াজ আজও অক্ষত রয়ে গেছে বংশ পরম্পরাতে।
বছরের বিভিন্ন সময়েই এই বাড়িতে সারাবছর ধরেই বিভিন্ন পুজো অর্চনা অনুষ্ঠিত হয়। আর অতীতের সব নিয়ম, নীতি নিষ্ঠাভরে পালনের জন্য পুজো শুরুর থেকেই পরিবারের পূর্ব পুরুষেরা ‘অর্পণ নামা’য় সব পুজোর বিভিন্ন নিয়মবিধি উত্তরপুরুষের জন্য লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
এই পরিবারে দেবী মহিষামর্দিনী রূপে আসেন না। তিনি এখানে শান্তি দায়িনী হরগৌরী রূপেই বিরাজিতা। দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকে সরস্বতী, লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক। ষাঁড়ের উপর শিব, শিবের কোলে মা দুর্গা। থাকে না মহিষাসুর অথবা সিংহ।
উল্টোরথের দিনই পুজোর ঢাকে কাঠি পরে কুণ্ডুচৌধুরী বাড়িতে। শুরু হইয়ে যায় পুজোর প্রস্তুতি। নিষ্ঠার সঙ্গে ওই দিনই নিয়ম মেনে প্রতিমা তৈরির জন্য কাঠামোর বাঁশ কাটা হয়। আর মহালয়ের পরদিন প্রতিপদ থেকে পুজোর প্রতিটি দিনেই নিয়ম করে চণ্ডীপাঠ করা হয়। বাড়ির একতলার ঠাকুরঘর লক্ষ্মী জনার্দনের কাছে পঞ্চমী পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চমী পুজো। ষষ্ঠীতে বেলতলাতে পুজোর মাধ্যমে বোধন সম্পন্ন হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চার দিন নির্দেশিত পারিবারিক রীতি-নীতি মেনে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কুণ্ডুচৌধুরী বাড়ির পুজো বৈষ্ণব মতে সম্পন্ন হয় তাই কোনো নিরীহ পশুর বলি সম্পন্ন হয় না। যদিও পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী বাতাবি লেবু বলি হলেও তা প্রকাশ্যে করা হয় না। পুজোর একটি নির্দিষ্ট দিনে হরিনাম সংকীর্তনের আসর বসে বাড়িতে। অষ্টমীতে পরিবারের বিবাহিত মহিলাদের দ্বারা ধুনো পোড়ানোর আচার সম্পন্ন হয়। আর নবমীর সন্ধ্যা থেকে শুধুমাত্র পরিবারের বিবাহিত মহিলারাই কাঠের একটি প্রতীকী নৌকোকে কয়েন, কড়ি, সিঁদুর, নতুন গামছা দিয়ে সাজিয়ে বিশেষ স্থানে রেখে দেয়। আর দশমীর দিন তার পুজোর পর পুনরায় ঠাকুর ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেওয়া হয়। ফের কয়েক ছয়েক বাদে বাসন্তী পুজোর নবমীর দিন প্রতীকী নৌকোটি বের করে সাজানো হয়।
এভাবেই বংশ পরম্পরার হাত ধরে তিনশো বছর ধরে মাতৃ আরাধনাতে ব্রতী হয়ে রয়েছে মৌড়ির কুণ্ডুচৌধুরী বনেদি বাড়ি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × three =