সুস্মিতা মণ্ডল
রিষড়া: ‘ফাইট, কোনি ফাইট’…
জনপ্রিয় বাংলা ছবি ‘কোনি’-তে কোনির জন্য লড়ে গিয়েছিলেন ‘ক্ষীদ্দা’। ছাত্রী ও কোচের কঠোর পরিশ্রমে ধরা দিয়েছিল জয়।
আর বাংলায় কমনওয়েলথে সুযোগ পাওয়া অনিলের জন্য লড়ছেন ‘সুদীপ্ত স্যার’। সঙ্গে রয়েছেন আর এক মেন্টর কৌস্তভ বক্সীও। প্রতিদিন বিকেল হলেই রিষড়ার একটি পুকুরে চলে আসেন উত্তরপাড়ার অনিল। ঘড়ি ধরে, মুখে বাঁশি নিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করান কোচ সুদীপ্ত নন্দী। শুধু সাঁতার তো নয়, যে সুযোগ অনিল পেয়েছেন তাতে আছে বিশাল চ্যালেঞ্জ। মানুষের প্রাণ রক্ষার।
জল ভরা প্রায় ৮০ কেজির ম্যানিকিন (মানুষের মতো পুতুল) নিয়ে পুকুরে প্রতিযোগিতার নিয়ম মেনে সাঁতার অভ্যেস করেন অনিল। ক্লান্ত হলেও উপায় নেই, কোচের কড়া নজর। দু’জনেরই লক্ষ্য একটাই, ‘জয়’।
কমনওয়েলথ লাইফ সেভিং চ্যাম্পিয়নশিপস ২০২৩-এ (Commonwealth Life Savings Championships 2023)অংশ নেবেন হুগলির উত্তরপাড়ার অনিলকুমার সাউ। আগামী সেপ্টেম্বরে কানাডার ওন্টারিও-র উইন্ডসরে (Windsor, Canada)হতে চলা এই প্রতিযোগিতায় ভারত থেকে ১২ জন প্রতিযোগী নির্বাচিত হয়েছেন। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাত্র দু’জনই অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। একজন অনিল, অন্য জন আহেলি সাহা।
তবে এত লড়াই করে পাওয়া সুযোগের পরও অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গিয়েছে অনিলের। কমনওয়েলেথে অংশ নেওয়ার জন্য দরকার ২ লক্ষ ৫৮ হাজার টাকা। অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের ছেলে অনিল। নিজে কলেজ পড়ুয়া। বিসিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবা সাধারণ কাজ করেন। দাদাই সংসার দেখেন, আয় তেমন নয়। পরিবারের সদস্যদের ভরণ পোষণের পর ভাইয়ের প্রতিযোগিতার মোটা টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তবে হাল ছাড়তে নারাজ। ভাইকে হারতে দিতে চান না দাদা সুনীল সাউ। অনিল ও সুনীলের সকলের কাছে আবেদন, কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসুক। যাতে শেষ মুহূর্তে অর্থের জন্য কানাডা যাওয়া না আটকায়।
একই আবেদন অনিলের কোচ সুদীপ্ত নন্দীরও। তাঁদের ক্লাব বা সংগঠন প্রতিযোগীদের পাশে থাকলেও, অনেক টাকার দরকার। কেউ স্পনশর করলে সুবিধে হবে অনিলের। সুদীপ্ত নন্দী সিআরপিএফ-এ সাঁতারের প্রশিক্ষক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন। এখন তাঁর একটাই স্বপ্ন, বাংলার ঘরে ঘরে যে প্রতিভা রয়েছে, তাঁদের খুঁজে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে দেওয়া। দেশের হয়ে প্রতিযোতিায় অংশ নেওয়ার জন্য দক্ষ প্রতিযোগী তৈরি করা।
সুদীপ্ত নন্দী জানালেন, আরএলএসএস ও কমনওয়েলথ লাইফসেভিং চ্যাম্পিয়নশিপস সম্পর্কে। এক্ষেত্রে সাঁতারের সঙ্গে জুড়ে থাকে মানবিক একটি দিক। এর লক্ষ্য হল দক্ষ সাঁতারুদের জীবন বাঁচানোতেও দক্ষ করে তোলা। চলতি বছরের জুন মাসে বেঙ্গালুরুতে আয়োজিত (লাইফ গার্ড বিভাগে) ১৮তম ন্যাশনাল পুল লাইফসেভিং চ্যাম্পয়িনশিপে চারটি ইভেন্টে সোনা জেতেন অনিল সাউ। তারপর বাছাই করা ২৫ জনকে নিয়ে পুনেতে হয় কমনওয়েলথ-এর জন্য সিলকেশন ট্রায়াল। তার মধ্যে থেকে ১২ জন নির্বাচিত হন। সেখানেই নাম উঠে আসে অনিল ও আহেলির।
কানাডার উইন্ডসরে ১৩-১৮ সেপ্টেম্বর হবে কমনওয়েলথ। সেখানেই ‘১০০ মিটার ম্যানিকিন ক্যারি উইথ ফিন’ ও ‘১০০ মিটার ম্যানিকিন টো ডইথ ফিন’-এ অংশ নেবেন অনিল।
কিন্তু কেন লাইফ সেভিং-এর ওপর উৎসাহ জন্মাল অনিলের? জানালেন, বয়স যখন তাঁর ৬-৭ দাদা গিয়ে বালি সুইমিং পুলে ভর্তি করেছিল। তখন থেকেই সাঁতারের প্রশিক্ষণ। পরবর্তীতে স্টেট লেভেলে অংশ নেওয়া। একবার আরএলএসএস (রাষ্ট্রীয় লাইফ সেভিং সোসাইটি)-র কৌস্তভ বক্সী বালির সুইমিং ক্লাবে এসে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। কীভাবে ডুবে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করতে হবে, কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করতে হবে? প্রাণ বাঁচানোর এই প্রশিক্ষণ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে।
২০২১ সালে টালা পার্কে তিনি লাইফ গার্ডের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন অনিল। তারপরই সাঁতারের এই নতুন ধারায় ন্যাশনালেও অংশ নেন। জয় আসে। এবার সুযোগ মিলেছে কমনওয়েলথে। বৃহস্পতিবারই পুনেতে ‘ইন্ডিয়া ক্যাম্পের’ জন্য রওনা হচ্ছেন অনিল। সেখানেই থাকবেন আর এক মেন্টর কৌস্তভ বক্সী। সেখানেই হবে অনিলের শেষ মুহূর্তের প্র্যাকটিস। তবে ভয় একটাই, টাকার জন্য সবটা আটকে যাবে না তো!
‘১০০ মিটার ম্যানিকিন ক্যারি উইথ ফিন’
—
প্রতিযোগী পায়ে ফিন লাগিয়ে ৫০ মিটার সাঁতরে গিয়ে, জলের তলা থেকে ম্যানিকিন (প্রায় ৮০ কেজি) তুলে একহাতে সেটা ধরে সাঁতরে আবার ৫০ মিটার ফিরবে।
‘১০০ মিটার ম্যানিকিন টো ডইথ ফিন’
—
রেসকিউ টিউব নিয়ে সাঁতরে যাবেন প্রতিযোগী, অন্য প্রান্তে তাঁর পার্টনার ম্যানিকিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। সেই ম্যানিকিন টিউবে আটকে সাঁতরে আসতে হবে। ম্যানিকিনের নাক জলের ওপরে থাকবে।
তথ্য: কোচ সুদীপ্ত নন্দী