প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে উদ্বোধন হল নয়া সংসদ ভবনের। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় শাসক-বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই।এদিনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদি ছাড়াও বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা, প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া সহ এনডিএ জোট অন্তর্ভুক্ত কমপক্ষে ১৮ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সামিল হয় ২৫টি বিরোধী দলও। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করে কংগ্রেস, তৃণমূল, আম আদমি পার্টি সহ ২০টি বিরোধী দল।
রবিবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শুরু হয় সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এদিন পায়ে হেঁটে নতুন সংসদ ভবনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানান লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা। প্রথমেই মোদি মহাত্মা গান্ধি মূর্তিতে প্রণাম জানান। সংসদ চত্বরে প্রধানমন্ত্রী পৌছতেই শুরু হয় যজ্ঞ ও পুজো। এরপর দুই দফায় বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সংসদ ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন হয়। এরই মাঝে নির্মাণকর্মী থেকে সাফাইকর্মী, যাঁরা নতুন সংসদ ভবন তৈরিতে সাহায্য করেছেন, তাঁদের চাদর পরিয়ে সম্মানিত করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
প্রথম দফার অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল সাড়ে ৭টায়। সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত বিশেষ পুজোর মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান নতুন সংসদ ভবনের। এই পুজোর পর সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ঐতিহাসিক সেঙ্গোল হাতে নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লোকসভা কক্ষে স্থাপন করা হয় এই সেঙ্গোল।অধ্যক্ষের আসনের পাশে স্থাপন করা হবে এই রাজদণ্ড। এরপর সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত লোকসভাতে হয় সর্ব ধর্মের এক প্রার্থনা সভা। ওই প্রার্থনা সভায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, লোকসভার স্পিকার, রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান, মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাধু-সন্ন্যাসীরা। সংসদে পুজো হয় আদি শিব ও আদি শঙ্করার। পুজো, সেঙ্গোল প্রতিস্থাপনা ও প্রার্থনাসভার পর দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বের শুরু। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমেই শুরু হয় এই দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় পর্বের এই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বার্তা পড়ে শোনান রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। সঙ্গে পড়া হয় উপরাষ্ট্রপতির বার্তাও। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় সকলকে শুভেচ্ছা জানান। আগামীদিনে এই সংসদ ভবন অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি করবে বলেও জানান তিনি। সঙ্গে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান এও জানান, আগামীদিনে সাংসদ সংখ্যা বাড়তে পারে। এরপর নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সংসদ ভবনের ভিতরে দুটি শর্ট ফিল্ম দেখানো হয়।এরপর সকলের বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭৫ টাকার কয়েন ও স্ট্যাম্প প্রকাশ করেন।
নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের পরই টুইট করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটে লেখেন, ‘সংসদের নতুন বিল্ডিং উদ্বোধনে আমাদের হৃদয় গর্ব, আশা ও প্রতিশ্রুতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আশা করি দেশকে উন্নয়নের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এই সংসদ ভবন।’ এরপরই সাভারকর জয়ন্তী উপলক্ষে নয়া সংসদ ভবনে সাভারকরের ছবিতে ফল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।
এরপরই প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে জানান, ‘প্রত্যেকটি দেশের উন্নয়নের যাত্রাতেই এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। আজ, ২৮ মে এমনই একটি দিন। নতুন সংসদ ভবন শুধু একটা বিল্ডিং নয়, এটা দেশের ১৪০ কোটি মানুষের আকাক্ষ্মার প্রতীক। এই সংসদ ভবন বিশ্বকে দেশের কঠিন মনোবলকে তুলে ধরা হয়।’ এরই পাশাপাশি এও বলেন, ধীনতার ৭৫ তম বর্ষে, এই অমৃতকালে দেশের সাধারণ মানুষ এই নতুন সংসদ ভবন উপহার দিয়েছেন। আজ সকালেই সংসদ ভবনে প্রার্থনা করা হয়েছে। আমি সকল দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানাই। নতুন সংসদ ভবন আত্মনির্ভর ভারতের উত্থানের সাক্ষী হয়ে থাকবে। নীতিকে নির্মাণ, ইচ্ছাশক্তিকে কর্মশক্তিতে পরিণত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হবে। এই নতুন ভবন আত্মনির্ভর ভারতের সূর্যোদয়ের সাক্ষী। এই নতুন ভবন নতুন ও পুরাতনের সহ-অবস্থানের প্রতীক।’ এরপরই তুলে ধরেন সেঙ্গোল এর কথা ।বলেন, ‘আমরা নতুন সংসদে লোকসভায় পবিত্র সেঙ্গোল স্থাপন করেছি। চোস সাম্রাজ্যে সেঙ্গোলকে কর্তব্য, রাষ্ট্র ও সুশাসনের প্রতীক ছিল। তামিলনাড়ু থেকে আগত আধিনমের সন্তরা আশির্বাদ দিতে এসেছিলেন। সংবাদমাধ্য়মে এই সেঙ্গোল নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন বের হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা পবিত্র সেঙ্গোলকে তার গরিমা ফেরাতে পেরেছি। মান-মর্যাদা দিতে পেরেছি। যখনই সংসদে কার্যাবলী শুরু হবে, সেঙ্গোল আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।’ পাশাপাশি তুলে ধরেন ভারতের মন্দির থেকে মূর্তি, ভারতের বাস্তু ও বিশেষজ্ঞতার কথাও। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘ভারতের কৌশল বিশ্বে সমাদৃত ছিল। কিন্তু শতাধিক বছরের দাসত্ব আমাদের থেকে এই গৌরব ছিনিয়ে নিয়েছে। এক সময়ে আমরা অন্য দেশের নির্মাণ দেখে মুগ্ধ হতাম। একবিংশ শতাব্দীতে ভারত দাসত্বের ভাবনাকে পিছনে ফেলে এসেছে। প্রাচীন কলার ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনছে। আজ নতুন সংসদ ভবনকে দেখে সকল ভারতীয় গর্বিত।’ এরই সঙ্গে এই নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান,’ পুরনো সংসদ ভবনে সকলের জন্য নিজেদের কাজ করতে কত সমস্যা হচ্ছিল, তা আমরা জানি। বসার জায়গার সমস্যা ছিল, প্রযুক্তিগত সমস্যা ছিল। বিগত দেড়-দুই দশক ধরে আলোচনা হচ্ছিল যে নতুন সংসদ ভবনের প্রয়োজন। আগামিদিনে সাংসদের সংখ্যা বাড়বে, ওরা কোথায় বসবেন? এটা সময়ের চাহিদা ছিল যে নতুন সংসদ ভবন তৈরি হোক। আমার বলতে গর্ব হচ্ছে আধুনিক সমস্ত প্রযুক্তির সুবিধা রয়েছে।’ পাশপাশি এও বলেন, ‘নতুন সংসদ ভবন শুধু বিল্ডিং নয়, ১৪০ কোটি মানুষের আকাক্ষ্মার প্রতীক। আর এই নতুন ভবন আত্মনির্ভর ভারতের সূর্যোদয়ের সাক্ষী।’ একইসঙ্গে তাঁর এই ৯ বছরের শাসনকালে কেন্দ্রীয় সরকার আমজনতার জন্য কী করেছে তার খতিয়ান দিতে গিয়ে তিনি জানান, একইসঙ্গে যখনই আমরা ভাবি ৪ কোটি মানুষের মাথার উপরে ছাদ ও ১১ কোটি শৌচালয় তৈরি হয়েছে বিগত ৯ বছরে, এটা আমাদের অপরিসীম তৃপ্তি দেয়। যখন আমরা নতুন সংসদ ভবনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কথা বলি, তখন এটাও পরিপূর্ণবোধ দেয় যে আমরা ৪ লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি পথ তৈরি করেছি দেশের গ্রামগুলিকে সংযুক্ত করার জন্য। পঞ্চায়েত ভবন থেকে সংসদ ভবন, আমাদের অনুপ্রেরণা হল দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন। নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণ নিয়ে আজ আমরা অত্যন্ত গর্বিত। একইসঙ্গে এও জানান, ‘নতুন সংসদ ভবন আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিষেবায় পরিপূর্ণ। এই সংসদ ভবন ৬০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছে। তাদের এই কঠোর পরিশ্রমকে সম্মান জানাতে আমরা ডিজিটাল গ্যালারি তৈরি করেছি।’
এদিকে এদিনের এই অনুষ্ঠানে বিজেপির নেতৃত্বে তৈরি এনডিএ জোটের কমপক্ষে ১৮ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ছিলেন এনডিএ জোটের বাইরে কমপক্ষে ৭টি বিরোধী দলের সদস্যরাও। এই দলগুলির মধ্যে ছিল জনতা দল (সেকুলার), শিরোমণি আকালি দল, বিএসপি, লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস) বিজেডি, টিডিপি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেস। তবে ২০টি বিরোধী দল নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করেছে। এই দলগুলি হল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, আম আদমি পার্টি, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, এনসিপি, জেডিইউ, আরজেডি। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করেছে একাধিক বিরোধী দল। এ দিন এনসিপি সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে বলেন, ‘বিরোধী ছাড়া নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন অসম্পূর্ণ। এর অর্থ হল দেশে কোনও গণতন্ত্র নেই।’