কালো টাকা সাদা করতে ভুয়ো লোনের কারবার খুলেছিলেন অনুব্রত, এমনটাই দাবি করা হয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের চার্জশিটে। পাশাপাশি এও জানানো হয়েছে, মনীশ কোঠারির এক আত্মীয় হাওড়ার বাসিন্দা মনোজ মেহনত ‘অ্যাকোমোডেশন এন্ট্রি অপারেটর’ হিসাবে কাজ করতেন। তার বদলে মনোজ পেতেন কমিশন। একইসঙ্গে ইডি-র তরফ থেকে এও জানানো হয়েছে যে,’২০১৯ সাল থেকে মনোজ মেহনত তাঁর ৩টি পেপার কোম্পানি থেকে লোন করে দিয়েছিলেন অনুব্রতদের। সুকন্যার নামে থাকা ভোলে বোম রাইস মিল, নীল ডেভলপরস্ সহ বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এই লোন দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি সায়গল হোসেনের নামে থাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টেও কখনও ১৯ লক্ষ, কখনও ২৬ লক্ষ টাকা লোন দেওয়ার নথিও মিলেছে’ বলে জানানো হচ্ছে ইডি-র তরফ থেকে। এই ভাবেই ‘২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ২৫ টির বেশি ট্রানজাকশনের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার ভুয়ো লোনের ব্যবস্থা করেন মনোজ মেহনত।
এদিকে অনুব্রত কন্যা সুকন্যা যতই নিজে দাবি করুন না কেন তিনি কিছুই জানেন না তা সত্য নয় বলেই দাবি ইডি-র। অন্তত ইডি-র চার্জশিটের বয়ান দেখে এমনটাই ধারনা সকলের।কারণ, সুকন্যা মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের যে বয়ান উঠে এসেছে, তাতে তাতেও তিনি কিছুই জানেন না এটাও সত্য নয় বলেই প্রমাণ হচ্ছে বারবার। প্রসঙ্গত, গরু পাচার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বাবার মতোই তিহার জেলে বন্দি সুকন্যা। অথচ প্রাথমিক স্কুলে পড়িয়েও সুকন্যা বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেই প্রাথমিক ভাবে জানানো হয়েছিল।এরপর তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারী আধিকারিকেরা জানতে পারেন, ব্যবসা থেকে সম্পত্তি, বাবা-মেয়ে একে অপরকে রীতিমত টেক্কা দিয়েছেন গত কয়েক বছরে।
ইডি-র তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, গরু পাচারের টাকা কোন কোন খাতে ইনভেস্ট করা হবে তার অনেকটাই ঠিক করতেন সুকন্যা নিজে। অথচ, প্রথম দিকে ব্যবসার বিষয়ে অথবা টাকা কী ভাবে গচ্ছিত রাখতে হবে, তার কোনও ধারণাই ছিল না বাবা-মেয়ের। সেজন্য আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল মনোজ মাহনত নামে একজনকে। এই মনোজকে আবার অনুব্রত এবং সুকন্যার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মণীশ। তদন্তে উঠে এসেছে, এএনএম এগ্রোচেম ফুডস প্রাইভেট লিমিটেড এবং নীর কোম্পানি কিনতে অনুব্রতকে সাহায্য করেন তিনি। এরপর এর অল্প দিনের মধ্যেই টাকা পাচারের খেলার রাস্তা বুঝে ফেলতে অসুবিধা হয়নি অনুব্রত-সুকন্যার। কী ভাবে, কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে, কী ভাবে কোম্পানি খুলে টাকা সরানো যায়, তার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম দিকে অনুব্রত বিষয়টি দেখভাল করলেও, পরে মেয়ে সুকন্যাই ব্যবসার কন্ট্রোল পুরোপুরি নিয়ে নেন বলে চার্জশিটে ইডির দাবি। নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এএনএম এগ্রোচেম ফুডস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিটি কেনা হয় সুকন্যার নামে।
এদিকে ২০১৭-২০১৮ সালে মা ছবি মণ্ডলের সঙ্গে ওই সংস্থায় ৫০-৫০ শতাংশের শেয়ার ছিল সুকন্যার। আর এখন ওই কোম্পানিতে সুকন্যার শেয়ার যেখানে ৭৫ শতাংশ। সেখানে অনুব্রতর শেয়ার রয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। সকলের চোখে ধুলো দিতে সংস্থার ‘ডামি ডিরেক্টর’ পদে দেখানো হয় তাঁদের বাড়ির পরিচারক বিদ্যুৎবরণ গায়েনকে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সাল থেকে অনুব্রত মণ্ডলের পরিচারকের কাজ করতেন এই বিদ্যুৎবরণ। তাঁর নামে গাড়িও কেনা হয়। বিদ্যুতের নামে অ্যাকাউন্টও খুলে তার নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রেখে দেন সুকন্যা। ২০১৮-১৯ সালে জমা দেওয়া আয়করের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের নামে।
এদিকে আবার ২০১৯-২০ সালেও জমা পড়েছে ৬৫ লক্ষ টাকা। বিদ্যুতের দাবি, তিনি কোনও কোম্পানি বা আয়করের বিষয়ে কিছু জানতেন না। সবই জানেন সুকন্যা এবং মণীশ কোঠারি। ওই দু’জনেই বিভিন্ন কাগজপত্রে তাঁকে দিয়ে সই করাতেন।
অন্যদিকে, নীর ডেভলপমেন্ট কোম্পানিতে সুকন্যার শেয়ার ছিল ৯১.৬৬ শতাংশ। ওই সংস্থায় কৌশলে যুক্ত করা হয়েছিল অনুব্রতর গাড়ির চালক তুফান মৃধাকে। ২০১৩ সাল থেকে অনুব্রত মণ্ডলকে চিনতেন তুফান। সেই সূত্রে সুকন্যাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতেন তিনি। এমনকী, বিভিন্নজনের সঙ্গে যখন ব্যবসার ডিল হতো, তখন তুফানের ২টি মোবাইল থেকেই কথা বলতেন সুকন্যা। ওই মোবাইল এবং সিম কার্ডও তাঁকে কিনে দিয়েছিলেন কেষ্ট-কন্যাই। ইডির জেরায় ওই সব কোম্পানি এবং তাঁর পরিবারের আর্থিক লেনদেনের দায় অবশ্য অনুব্রত, সুকন্যা এবং মণীশের উপরেই চাপিয়েছেন তুফান।
এদিকে ইডির জেরায় অনুব্রত দাবি করেছেন, মণীশ শুধু চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নন, তাঁর পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। সে কারণে সব কিছুই মণীশের উপরেই তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবার সুরেই বয়ান দিয়েছেন মেয়েও। কিন্তু মনীশ নিজের বয়ানে এসব কিছুর জন্যই পাল্টা দায়ী করেন অনুব্রত এবং সুকন্যাকে। এমনকী, এও দাবি রোজকার ব্যবসা এবং ব্যাঙ্ক লেনদেনের বেশির ভাগই সামলাতেন এই সুকন্যাই।