শিক্ষা দপ্তরে নিয়োগ দুর্নীতিতে মাথা গোপাল-ই, দাবি ইডির

নিজেকে ‘সুবোধ’ বলে দাবি করলেও শিক্ষা দপ্তরে নিয়োগ দুর্নীতির নেপথ্যে মাথা গোপাল দলপতি-ই এমনটাই দাবি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি-র। এদিকে ইডি সূত্রে এও খবর, চার্জশিটে গোপালের বিরুদ্ধে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য জানানো হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে তাপস মণ্ডল, কুন্তল ঘোষ ও শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘গভীর জলের মাছ’ বলে মনে করা হলেও, টাকা কামানোর খেলায় গোপাল ওরফে আরমান গাঙ্গুলিও এঁদের থেকে মোটেই পিছিয়ে ছিলেন না বলেও জানানো হয়েছে চার্জশিটে।
শুধু তাই নয়, গোপালই পথ দেখাতেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি ও বর্তমানে ধৃত মানিক ভট্টাচার্যকে কী ভাবে তুষ্ট করতে হবে। চিনার পার্কের কাছে কুন্তলের ফ্ল্যাটে টাকার ভাগভাগি নিয়েও শান্তনুর সঙ্গে বেশ ক’বার বৈঠক করেন গোপাল। এদিকে সবথেকে আশ্চর্যের ঘটনা হল, ইডি এবং সিবিআই দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গোপালকে একাধিক বার জেরা করলেও এখনও গ্রেপ্তার করেনি। কিন্তু কুন্তলের গ্রেপ্তারির পর যে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট আদালতে জমা পড়েছে, তাতে আগামী দিনে গোপালের বিপদ বাড়ার ইঙ্গিত কিন্তু সুস্পষ্ট।
একইসঙ্গে ইডি-র এই চার্জশিটে এও জানা যাচ্ছে, ২০১৪-র টেটে অসফল ৯৯ জনকে কী ভাবে নিয়োগ করা যায়, তা নিয়ে যখন কোনও পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সে রাস্তাও কুন্তলকে দেখান এই গোপাল-ই। তাঁর সঙ্গে পার্থ ও মানিকের একাধিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির ভালো পরিচিতি ছিল। গোপালের মাধ্যমে বিকাশ ভবনে কুন্তলের সঙ্গে এক ‘ঘনিষ্ঠে’র গোপন বৈঠকও করান এই গোপাল। তবে কৌশলে মানিকের সঙ্গে মিটিং এড়িয়ে যান। এরপর চিনার পার্কে কুন্তলের ফ্ল্যাটে বৈঠকে বসেন গোপাল ও তাপস। গোপাল জানান, এসএসসি-এর ওয়েবসাইটে ২০১৪ টেটের তালিকায় অযোগ্যদের নাম তোলা যাবে। তবে এ জন্য বেশি খরচ করতে হবে। ২০১৭-র মধ্যে বেশ ক’জনের চাকরি করিয়ে দেন গোপাল। এরপর তাঁকে ৩৫ জন চাকরিপ্রার্থীর তালিকা দেওয়া হয়। নিয়োগ-কারবারে গোপালের প্রধান ভরসা ছিলেন শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত দুই আধিকারিক। চার্জশিট অনুযায়ী, নিয়োগ নিয়ে তাপস ও কুন্তল বেকায়দার পড়েছেন দেখে গোপাল দর বাড়াতে থাকেন। প্রার্থীপিছু ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। অর্থাৎ ৩৫ জনের জন্য ৭ কোটি। এতে রাজিও হয়ে যান ওই দু’জন। এরপরই নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশে নিয়োগ করা হয় অযোগ্যদের। আর এখানেই একাদশ-দ্বাদশে নিয়োগ পান তাপসের ছেলে ব্রিজেশ। বাকি ৩৪ জন চাকরি পান নবম-দশমে। এর বাইরে কুন্তল একটি তালিকা দেন গোপালকে। কিন্তু টাকা না মেটানোয় তাঁদের আর চাকরি হয়নি। ইডি সূত্রে এও দাবি করা হচ্ছে যে, টেটে সফলদের ইন্টারভিউয়ের সিলেকশন হয়েছিল দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত ওই দুই আধিকারিকের নির্দেশে। এরপর শান্তনুর সঙ্গে গোপালের বৈঠকের ব্যবস্থা করেন কুন্তল। তখন বড় ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এই গোপাল। ফলে শান্তনুকে জানানো হয়, গ্রুপ-ডি কর্মী পদে নিয়োগে সমস্যা হবে না। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা পেরোতে হবে প্রার্থীদের। ইন্টারভিউয়ের সময়ে নিজের লোক থাকবে বলে আশ্বাস দেন গোপাল। এর পর ৫২ জনের তালিকা দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁরা চাকরি পান। বিনিময়ে দিতে হয় ২ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা।
এদিকে আবার, উচ্চ প্রাথমিকে চাকরির জন্য ৪৩৫ জনের তালিকা দেওয়া হয় গোপালকে। আর এই ঘটনা থেকেই সমস্যার শুরুয়াৎ। গোপালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাপস টাকা দিতে অস্বীকার করেন। এদিকে আবার ২০১৮ সালে এই টানাপড়েনের মধ্যেই হাইকোর্টে নিয়োগ নিয়ে মামলা হয়। আদালতের নির্দেশে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ হয়। এঁদের কয়েকজন মেধাতালিকায় স্থানও পান। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে, সেই রেজাল্ট স্থগিত হয়ে যায়। এর পর তাপস ও কুন্তল গোপালের কাছে বাকি প্রার্থীদের টাকা ফেরত চান। জানা গিয়েছে, তা না দিয়ে গোপাল মোবাইল বন্ধ করে ছ’মাস বেপাত্তাও হয়ে যান। এদিকে এরপরই ২০১৯-এ চিটফান্ড কেসে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ গোপালকে গ্রেপ্তার করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × two =